শেষ পর্ব
উত্তাল মার্চে পূর্ব বাংলার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু ও বাংলার আকাশে স্বাধীনতার পতাকা
৩ জানুয়ারি ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে জনপ্রতিনিধিদের জনসভায় শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই জানিয়ে বলেন, ৬ দফা এখন আর পার্টির সম্পত্তি নয় এবং ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণীত হবে। ৯ জানুয়ারিতে রাওয়ালপিন্ডি গিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণের প্রস্তাব শেখ মুজিব ফিরিয়ে দেন।
১ মার্চ ১৯৭১ ইয়াহিয়া রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার অজুহাতে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে প্রতিবাদে শেখ মুজিব ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আহবান করেন। ২ মার্চ আ স ম রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শিব নারায়ন দাশের নকশা করা প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ইয়াহিয়া ৫ মার্চ বেতার ভাষণের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের তারিখ ২৫ মার্চ ঘোষণা এবং ৬ মার্চ ভাইস-অ্যাডমিরাল এস এম আহসানকে অপসারণ করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করেন। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্রের কালোরূপ প্রকাশ পেতে থাকে।
৭ মার্চ পূর্বঘোষিত জনসভার দিনে মুক্তিকামী বাঙালি জনতার স্বপ্নপূরণে বেগম মুজিব শেখ মুজিবকে মন যা চায় তা বলার পরামর্শ দেন। ঐদিন অজস্র মানুষে পরিপূর্ণ রাস্তা পার হয়ে বাঁশের লাঠি-ফেস্টুন-পতাকা হাতে নিয়ে লাখো জনতার সমুদ্রসম পরিবেশে রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে উপস্থিত মহানায়ক শেখ মুজিব শুরু করলেন পর্যায়ক্রমিকভাবে সাজানো দিকনির্দেশনাপূর্ণ কালজয়ী প্রায় ১৯ মিনিটের অলিখিত দীপ্ত ভাষণ। “ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি... আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়… আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। … প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। ...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা”।
অবসংবাদিত নেতার এই ভাষণ শুধু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীনতার প্রস্তুতিই নয় স্বাধীনতার ঘোষণাও। ৮ মার্চ ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ সংগঠনের নাম থেকে পূর্ব পাকিস্তান শব্দ বর্জনের সাহসী সিদ্ধান্ত নেয় এবং প্রাদেশিক গভর্নর টিক্কা খান ঢাকায় পৌঁছেন। ৯ মার্চ শেখ মুজিব গভর্নর হাউজে গিয়ে টিক্কার সাথে আলোচনার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন, ১০ মার্চ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা ঢাকা ছাড়েন এবং ১১ মার্চ টিক্কাকে শপথ পড়াতে প্রধান বিচারপতি সিদ্দিকী অস্বীকৃতি জানান। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়ে এবং শেখ মুজিবের নির্দেশ মতই চলতে থাকে সকল সরকারি-আধা সরকারি অফিস-আদালত ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ শিল্প কল-কারখানা। স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা না থাকায় পূর্ব বাংলার জনগণের আন্দোলনের তীব্রতা অগ্নিরূপ ধারণ করে।
১৫ মার্চ ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আগমন করেন। ১৭ মার্চ শেখ মুজিবের ৫২তম জন্মদিনে ইয়াহিয়ার সাথে দ্বিতীয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের শুভেচ্ছা জানানোর জবাবে বলেন যে, ‘আমি জন্মদিনের উৎসব করি না, এই দুঃখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই বা কী, আর আমার মৃত্যুদিনই বা কী?’ ১৬-২২ মার্চ ইয়াহিয়া-শেখ মুজিব-ভুট্টোর আলোচনা ভেস্তে গেলে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ২২ মার্চ চীনা দূতাবাস ছাড়া সর্বত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৩ মার্চ শেখ মুজিব ধানমন্ডির বাসার সামনে উপস্থিত বাংলার জনগণকে শৃংঙ্খলা বজায় রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বলেন। ২৪ মার্চ সকল প্রচেষ্টা ভেঙে গেলে শেখ মুজিব আগামীকালের মধ্যে কোনো সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজের পথ বেছে নিবে বলে হুঁশিয়ার করেন। ২৫ মার্চ সকালবেলা ইয়াহিয়া পূর্ব বাংলা ছেড়ে যান এবং শেখ মুজিব ২৭ মার্চ হরতাল আহবান করে বললেন ‘আমার কবরের ওপরে হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হবে’। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেনানিবাস ত্যাগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসসহ নানা স্থানে নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষের ওপর শুরু করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক গণহত্যা। নিরপরাধ বাঙালি নিধন পৃথিবীর ইতিহাসে জঘণ্যতম হত্যা হিসাবে চিরকাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে শেখ মুজিব প্রথমে ইংরেজিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন যার মর্মার্থ হলো আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন এবং যার যা আছে তা নিয়ে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করে শেষ সৈনিকটিকেও বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িতপূর্বক চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। পরে বাংলায় আরেকটি বার্তা পাঠান যার সংক্ষেপ হলো পাকিস্তান বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা মাতৃভূমি শত্রু মুক্ত করার জন্য বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছে এবং শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত আপসহীনভাবে পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য নিয়ে জয়ের লক্ষ্যে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। ২৫ মার্চ রাত ১টা ৩০ মিনিটে শেখ মুজিবকে পাক হানাদার বাহিনী ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে তিনদিন পরে পাকিস্তানে নিয়ে কারাগারে বন্দী করে রাখে। ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে শুরু হলো রক্তক্ষয়ী বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম যা চললো ৮ মাস ২১ দিন পর্যন্ত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ অর্জিত হলো সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণের মুক্তি ও স্বাধীনতা। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিব প্রথমে যুক্তরাজ্য ও পরে ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা রাখলে পূর্ণ হয় বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বাদ ও স্বপ্ন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মহান নেতা সকলের শেখ মুজিবই হলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। জয়বাংলা।
লেখক: অধ্যাপক ড. এ কে এম মাহবুব হাসান, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।