ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রস্তাবিত বাজেটে জীবন ও জীবিকার রূপরেখা 

তপন চক্রবর্তী, ডেপুটি এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৫ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২১
প্রস্তাবিত বাজেটে জীবন ও জীবিকার রূপরেখা  ...

একটি বাজেটের মূল লক্ষ্য সম্পদের পুনর্বণ্টন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আয় বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি। দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে বৃহস্পতিবার (৩ জুন) জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষিত ২০২১-২২ অর্থবছরের ৫০তম বাজেটে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।

 

এ বাজেটে বিশ্বব্যাপী চলমান মহামারী করোনার ক্ষতি থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, স্বাস্থ্য খাতের প্রয়োজন মেটানো এবং ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যও পূরণ হবে।  

প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির ১৭.৫ শতাংশ। এই বাজেটে পরিচালনসহ অন্য খাতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা।

করোনাকালে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে যারা বিত্তবান, তাদের কাছ থেকেই বেশি কর আহরণে জোর দেওয়া হয়েছে এই বাজেটে। এজন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিত্তশালীদের সারচার্জ বাড়ানোর পাশাপাশি তা আদায় প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে। করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে অধিক জোর না দিয়ে আগামি অর্থবছরে বিদেশি অর্থায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর এবং নতুন কাস্টমস আইন ২০২০ সংসদে পাস হলে আগামি অর্থবছরের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

এই ব্যয় নির্বাহের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ১১.৩ শতাংশ। এরমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উৎস থেকে পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব আসবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর-বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরণ হবে আরও ৪৩ হাজার কোটি টাকা।

প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি এবং সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়ন বিবেচনায় নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের ডিজিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন সংশোধন করে ৬.১ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর কোভিড-১৯ পরবর্তী উত্তরণ বিবেচনায় নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। এ সময়ে মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশের মধ্যে রাখা সম্ভব হবে।

করোনার টিকা আমদানিতে বাজেটে এবারও ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা প্রশংসাযোগ্য। টিকা সংগ্রহে চলতি অর্থবছরে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক ৩ হাজার কোটি টাকা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।  

গরিব জনগণের জীবনযাত্রা সহজ করতে প্রস্তাবিত বাজেটে  সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৭.৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩.১১ শতাংশ। দেশিয় শিল্পের বিকাশে সবক্ষেত্রে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্র্যান্ড’ প্রতিষ্ঠায় পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে ১০ বছর পর্যন্ত কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান তৃতীয় লিঙ্গের কর্মী নিয়োগ দিলে প্রতিষ্ঠানটি কর ছাড় পাওয়ার কথাও প্রস্তাবিত বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে।

আবার বাড়ির নকশা ও সমবায় সমিতির অনুমোদনে বাধ্যতামূলক টিআইএন নেওয়ার প্রস্তাবকেও অনেকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। ৫০ হাজার টাকার বেশি বিল ব্যাংকিং চ্যানেলে না নিলে উৎসে কর দিতে হবে। বাজেটে বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ করারোপেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি, প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচি, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী ভাতা কর্মসূচি প্রভৃতির আওতা বৃদ্ধি করার ফলে অসহায় মানুষ তার সুফল পাবে। এছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বিনিয়োগ, শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান প্রক্রিয়াকে গতিশীল করবে।

কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়াতে জিন প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় গবেষণা বাড়ানোর পাশাপাশি গবেষণায় উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারেরও উদ্যোগ নেওয়া হবে। ফলে কৃষিতে কর্মসংস্থান বাড়বে। ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি খাতে আরও ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান  হবে। ২০২৪ সালের মধ্যে সাড়ে ৮ লাখ কর্মীকে দক্ষ করা হবে। ১১টি খাতে ২৮টি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এসব কাজ করবে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে কর্মসংস্থান তৈরি, সরবরাহ চেইন ঠিক রাখতে ১৩০টি গ্রোথ সেন্টার করা হবে। এর আওতায় গ্রামীণ হাটবাজারকে উন্নয়ন করা হবে।  

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি জাগিয়ে তুলতে প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও বহাল রাখা হয়েছে। অর্থপ্রবাহ বাড়ানো, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও রাজস্ব বাড়াতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাজেট প্রস্তাবনায় চট্টগ্রামে নতুন চামড়া শিল্পনগর স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে চট্টগ্রামে চলমান ৪৩টি বড় প্রকল্পের জন্য প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে।

এই সুষম বাজেটের সুফল ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা সবক্ষেত্রেই মিলবে। তবে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, জুন ০৪, ২০২১
টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।