ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বঙ্গমাতাকে যেমন দেখেছি

সেলিমা খাতুন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২১ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০২১
বঙ্গমাতাকে যেমন দেখেছি

মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। অনিন্দ্য সুন্দর, সৌম্য, শান্ত, ধীরস্থির একজন মহিলা।

বৈবাহিক সম্পর্কে তিনি আমার আত্মীয়। মানুষকে আপন করে নেয়ার গুণে তিনি আমাকে তাঁর পরিবারের একজন করে নিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর আমি তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি।  

তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মহোদয় আমাকে ফোন করে অনুরোধ করেন, আমি যেন তাঁর সম্বন্ধে কিছু লিখি। খুবই দুরূহ কাজ এই মহীয়সী নারী সম্বন্ধে কিছু লেখা। দীর্ঘদিন তাঁর সংস্পর্শে গেছি কিন্তু চিনতে পেরেছিই বা কতটুকু বহুগুণের অধিকারী এই নারীকে। তবুও লোভ সামলাতে পারলাম না আমার দেখা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে নিয়ে কিছু লিখতে।  

প্রথম দর্শনে বেগম মুজিবকে দেখে মনে হবে তিনি অতি সাধারণ একজন বাঙালি গৃহবধু। স্বামী সন্তান, আত্মীয়-পরিজন, কাজের মানুষ নিয়ে তিনি তাঁর সংসার পরিচালনা করা নিয়ে ব্যস্ত। তিনি সকলের খোঁজ খবর রাখতেন। নিজ হাতে রান্না করতে পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধু যখন জেলখানায় বন্দী থাকতেন, সে সময় দেখেছি জেলখানায় সাক্ষাৎ করার দিন সকাল থেকে বঙ্গবন্ধুর পছন্দের খাবার রান্না করে, তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে দেখা করতে যেতেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও তিনি নিজ হাতে রান্না করে গণভবনে খাবার পাঠাতেন।

১৯৬৪ সালে এস এস সি পাশ করে আমি ঢাকা শহরে চলে আসি বাবার হাত ধরে। ভর্তি হই গভঃমেন্ট ইন্টারমেডিয়েট গার্লস কলেজ, বকশীবাজারে। বর্তমানে এটি বেগম বদরুন্নেছা সরকারি কলেজ। ১৯৬৪ সালে শুধুমাত্র ১ম বর্ষ বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য শাখা নিয়ে এ কলেজের যাত্রা শুরু। এস এস সি পাশ করেছি তৎকালীন গাইবান্ধা মহকুমা শহর থেকে ৬ মাইল দূরের একটি গ্রামের স্কুল থেকে। সেখান থেকে একেবারেই রাজধানী ঢাকায়। থাকি ইডেন হোস্টেলে। বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন পরিবেশের মেয়েদের সাথে শুরু হয় বসবাস। রাজধানীর পরিবেশ তথা চলাফেরা, পথঘাট চেনা, পড়াশোনা ইত্যাদির সাথে খাপ খাওয়ানো খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। ইডেন হোস্টেলের কক্ষগুলো ছিল ৪ জনের। প্রত্যেকের জন্য একটি খাট, একটি পড়ার টেবিল, জিনিসপত্র রাখার জন্য একটি আলমারী। হঠাৎ একদিন কক্ষটিতে নতুন একজন ছাত্রী চলে আসে। আমাদের পছন্দ হলো না এই নতুন ব্যবস্থা, কিন্তু আপত্তি বা প্রতিবাদ করার ক্ষমতা কোথায় আমাদের। পরে শুনি রাজনৈতিক চাপে কর্তৃপক্ষ কক্ষগুলোতে এ নতুন ব্যবস্থা চালু করেন। “রাজনৈতিক চাপ” কথাটির সাথে সেই প্রথম পরিচয়।

১৯৬৫ সালে আমাদের কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্রী হয়ে এলেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা। ছিপছিপে লম্বাদেহি সাদামাটা একটি মেয়ে। সবসময়ই কিছু মেয়ে তাঁকে ঘিরে রাখে- কি ক্যান্টিনে, কি কমনরুমে। আমি দ্বিতীয় বর্ষের সিনিয়র ছাত্রী। বিজ্ঞানের ছাত্রী বলে ক্লাসের চাপও কিছুটা বেশি। ফলে কমনরুমে যাওয়া-আসা হয় কম। দূর থেকে তাঁকে দেখি-কাছে যাওয়া হয় না। ১৯৬৬ সালে তিনি কলেজের ভিপি নির্বাচিত হন। ঐ বছরেই আমরা কলেজ থেকে চলে আসি।  

১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সম্ভবত আমার মামা ড. ওয়াজেদ মিয়া পিএইচডি সম্পন্ন করে ঢাকায় ফিরে আসেন। হোস্টেলে বসে খবর পাই মামা বিয়ে করেছেন শেখ মুজিবের মেয়েকে। হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমাদের (আমি ও আমার ভাই)-কে নিতে পারেননি বলে মামা জানালেন। ঢাকাতেই থাকি তবুও নতুন মামীর সাথে দেখা হওয়া বা দেখা করার সুযোগ হয় না।

১৯৬৮ সালের কোন একসময় আমার মা, তাঁর মা অর্থাৎ আমার নানীকে সাথে করে ঢাকায় এলেন বেড়াতে। রোকেয়া হলে থাকি। খবর পেয়ে মার সাথে দেখা করতে চলে গেলাম মালিবাগে আমার ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ীতে। সেখানে গিয়ে শুনলাম তাঁরা চলে গেছেন আমার মামার কলেজ স্ট্রীট এর বাসায়। সেখানেও গিয়ে শুনি বেগম মুজিব তাঁদের নিয়ে গেছেন তাঁর বাসায়। এবার পড়লাম মহা বিপদে। সেখানে কিভাবে যাব আবার না গেলেও হবে না। তাঁদের সাথে দেখা করাও প্রয়োজন। দুরু দুরু বুকে সাহস সঞ্চয় করে গিয়ে হাজির হই ৩২ নম্বর এর বাসায়। ভীরু পায়ে বাসায় ঢুকে পরিচয় দেয়াতে কে যেন দোতলায় নিয়ে গেল মনে নেই। গিয়ে মা ও নানীকে পেলাম। এই হলো ৩২ নম্বরের বাড়ীতে প্রথম যাওয়া।  

বাসার সকলের আন্তরিকতায় আমি তাঁদের একজন হয়ে গেলাম। ১৯৬৮ সালে ৬ দফা দাবী পেশ করার কারণে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন আইয়ুব খান। বেগম মুজিব তখন একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিভাবে স্বামীকে মুক্ত করবেন সেই চিন্তা, সংসার চালানো, মামলা চালানো- সব এক হাতে তাঁকে সামলাতে হচ্ছিল। তার মধ্যে নতুন আত্মীয়ের প্রতি কর্তব্য পালন করতে তিনি ভোলেন নি। নিজ হাতে সে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন। বেশ আদর যত্নে রেখেছিলেন তাঁদের। মা ও নানী বেশ কয়েকদিন ছিলেন এবং আনন্দের সাথেই ছিলেন। আমার মা আমৃত্যু ঐ বাড়ীর আতিথেয়তা মনে রেখেছিলেন।

সেদিন থেকে ৩২ নম্বরের ঐ বাড়ীতে আমার অবাধ যাতায়াত। আমি বয়সে বড় তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এ কারণে  শেখ কামাল, শেখ জামালসহ সব ভাইবোনদের খালা হয়ে গেলাম। এমনকি আজিজ মিয়া (যিনি গরু রাখেন), ড্রাইভার মুন্সী, বাবুর্চি নেয়াজ মিয়া সকলেরই খালা। তাঁদের সাথে সাথে আওয়ামী নেতা কর্মীদেরও খালা হয়ে গেলাম। আওয়ামী লীগের অনেকে আমাকে এখনো খালা বলেই ডাকেন। ঐ বাড়ীটা ছিল শেখ পরিবারের মিলন মেলা। আত্মীয় অনাত্মীয় সবাই চলে আসতেন যখন তখন। বাড়ীটা সবসময় জমজমাট থাকতো। বঙ্গমাতা সকলের সাথে যোগাযোগ রাখা, আন্দোলন পরিচালনা করা ইত্যাদি ঘরে বসেই সুষ্ঠুভাবে করতেন। সবকিছুর উপরেই তাঁর ছিল একটি প্রচ্ছন্ন নিয়ন্ত্রণ। তিনি ধীরস্থির অবিচল থেকে সব দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাঁকে কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও তিনি ৩২ নম্বরের বাড়ীতে থেকে গেলেন। নিজ হাতে গড়া মমতায় ঘেরা এই বাড়ী। পরে শুনেছি অনেক কষ্ট করে একটু একটু করে তিনি তৈরী করেন এই বাড়ীটি। একদিন কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ হয়েছিল “গণভবন সরকারী বাড়ী, সেখানে গেলেন না কেন?”। তাঁর তাৎক্ষণিক উত্তর- “তোমাদের সরকারী বাড়ীতে যাব কোন ভরসায়, কখন বের করে দেয় তার ঠিক আছে”।  
১৯৫৪ সাল এবং ১৯৫৮ সালের সরকারি বাড়ী ছাড়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো তিনি একথা বলেছিলেন। ঘটনাও তাই ঘটলো ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টে শুধু তাঁর নিজ বাড়ী থেকে নয়, ঘাতকরা এ পৃথিবী থেকেই তাঁর পরিবারের সকলকে বিদায় করে দিল।  

১৯৬৯ সালের আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। ১৯৬৯ সালে রোকেয়া হলে থাকি। লাগাতার ধর্মঘট, ক্লাস বর্জন চলছে বিশ^বিদ্যালয়ে। কলেজ স্ট্রীটের বাসায় মামা সস্ত্রীক বসবাস করেন। সময় পেলেই যখন তখন মামার বাসায় যাই। ১৯ জানুয়ারি ৬৯, রোববার সকালে মামার কলেজ স্ট্রীটের বাসায় যাই। রাতে বাসায়ই থেকে গেলাম। সোমবার সকালে মামা অফিস যাওয়ার সময় বলে গেলেন ক্লাস হয় না খামাকা হ’লে কেন যাবে। মামার অনুরোধে বাসায় থেকেই গেলাম। দুপুর বেলা খেয়ে দেয়ে মামী এবং আমি দুজন বসে গল্প করছি। ৩টার দিকে হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখি বেগম মুজিব এসে হাজির। তাঁর মুখে শুনলাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। একজন ছাত্র মারা গেছে।  

তিনি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে চলে এসেছেন। খবর নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাবেন। আমরা তিনজন তাঁর গাড়ীতে করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাই। শহীদ মিনার পথে নীলক্ষেত এলাকা থমথমে, কোথাও কেউ নাই। কাঁদুনে গ্যাসের গন্ধে নিশ্বাস নেয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন চলছিল, পরবর্তীতে যা গণআন্দোলনে রুপান্তরিত হয়। তিনি বাড়ীতে থেকেই কিভাবে সব খবরাখবর রাখতেন, ভাবতেও অবাক লাগে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনি ছাত্র রাজনীতি, দলীয় রাজনীতির সব খবরাখবর রাখতেন। নেতা কর্মীরা কে কেমন আছে, কার কি সমস্যা- সবকিছু তিনি দেখাশোনা করতেন।

বেগম মুজিব সাদামাটা আড়ম্বরহীন জীবন-যাপন করলেও তাঁর চলাফেরা, কথাবার্তায় একটা আভিজাত্যের ছাপ ছিল। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি ছিল প্রখর। তিনি রসিকতা করতে পছন্দ করতেন। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহন এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন তিনি।  

বেগম মুজিব ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনা আলোকিত মানুষ। নিয়মিত বই পড়তেন, গান শুনতেন। সন্তাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি ছায়ানটেও পাঠিয়েছিলেন সেতার, বেহালা ইত্যাদি শিখতে। তাঁর উৎসাহে ফুটবল, ক্রিকেট, নাট্যচর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তাঁরা অবদান রেখেছিলেন। জেলখানায় থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুকে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাসমূহ লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। লেখালেখি করার জন্য জেলখানায় খাতা সরবরাহ করা এবং তা সযত্নে সংরক্ষণও করেছিলেন। যার ফলে আমরা পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর লেখা গ্রন্থাবলী।

তিনি ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিতা একজন আদর্শ বাঙ্গালী নারীর প্রতিচ্ছবি। তিনি বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি বিশ্বদরবারে আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন প্রতিদিন। সাহসী ও মহিমান্বিত ভূমিকার জন্য ইতিহাসের পাতায় “বঙ্গমাতা” হিসাবে তিনি চিরস্মরণীয় থাকবেন- একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ সহকারী

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।