ঘাটাইল (টাঙ্গাইল থেকে): ‘যখন কেউ স্যার বলে ডাকে তখন খুব ভালো লাগে, নিজেকে খুব বড় মনে হয়, খুব সম্মানিত মনে হয়’- আত্মবিশ্বাস ও সারল্যের মিশেলে কথাগুলো বলছিলেন সনি বেগম।
বৃহস্পতিবার (২৯ জানুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ ও শপথে অংশ নেওয়াদের অন্যতম সনি।
ঘাটাইলের (টাঙ্গাইল) শহীদ বীর উত্তম সিপাহী নুরুল হক প্যারেড গ্রাউন্ডে (আর্মি মেডিকেল কোর সেন্টার অ্যান্ড স্কুল-এএমসিসিঅ্যান্ডএস, শহীদ সালাউদ্দিন সেনানিবাস) এ অনুষ্ঠান হয়।
একই সঙ্গে চিকিৎসা সেবা ও দেশরক্ষায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৮শ’ ৭৮ জন নারী সৈনিকের একজন সনি।
বাংলাদেশের একটি ইতিহাসের অংশ হয়ে নিজের গর্বের কথা বলছিলেন তিনি।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, এখানে আপা বা ম্যাডাম বলে না কেউ, সবাই ‘স্যার’ বলেন সিনিয়রদের। আমাদেরও জুনিয়র ব্যাচের সবাই স্যার বলেন। তখন খুব ভালো লাগে। ’
বরিশালের মেয়ে সনির বাবা আবদুল আজিজ মোল্লা ও মা আছিয়া বেগম। চার সন্তানের মধ্যে সবার ছোট সনি এখন নয়নের মণি সবার।
নাটোরের মেয়ে জেসমিন আক্তার পুথি। শিক্ষক বাবা মো. জিয়াউর রহমান ও মা আরিফা বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে তিনিই বড়।
পুথি বাংলানিউজকে বলেন, আগে পথ চলতে ভয় লাগতো, এখন কোনো ভয়ই লাগে না। আমাদের পোশাকইতো শক্তি বাড়িয়ে দেয়, সেই সঙ্গে আছে প্রশিক্ষণ।
প্রায় একই কথা চাঁদপুরের তানজিনা আক্তারের মুখেও।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের দেশের জন্য জীবন দেওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এখন কোনো ভয়ই মনে আসে না।
‘একই সঙ্গে ডাক্তার ও সৈনিক আমরা। বাবা, আত্মীয়-স্বজন খুব খুশি। তাদের খুশি দেখে আরও ভালো লাগে’- বলেন তিনি।
শিক্ষক বাবা সেলিম মিয়া কোনোদিন মায়ের অভাব বুঝতে দেননি মা-হারা তানজিনাকে। আর এখনতো শুধু মেয়ের গল্পই তার মুখে- জানান তানজিনা।
কুমিল্লার মেয়ে তাহমিনা আক্তার। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পাড়া-প্রতিবেশীরা আম্মা-আব্বাকে খুব সম্মান দেয়, বলে- আপনাদের ভাগ্যটা খুব ভালো, এমন মানুষ করলেন মেয়েকে যে ছেলের চেয়েও বেশি নাম করলো।
মনোহরগঞ্জের কেশতলার ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান ও গৃহিনী মা মিনারা বেগমের মেয়ে তাহমিনা। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ।
পানি পানের সময় বোতলের পানিতে বুক ভিজে যায় মো. মুন্সের আলী মীরের। গভীর মমতায় বুক মুছে দেন নিতু। মেয়ের আদরে গর্বিত বাবার চোখ অশ্রুতে ভরে যায়।
অশ্রু চোখেই বাংলানিউজকে নড়াইলের মুন্সের আলী বলেন, মানুষ বলে- মেয়েরা নাকি বোঝা। তারা এখানে এসে দেখুক, এই মেয়েরাতো দেশের সম্পদ।
পাশে দাঁড়ানো নিতুর মা মোসাম্মৎ জান্নাতুল ফেরদৌস।
তিনি বলেন, নিতুর বাবার অফিসের সবাই এখন তাকে খুব মান্য করে। সবার এক কথা, এমন মেয়েতো লাখে একটা হয়। তার বাবা খুব খুশি হয়ে বাড়ি ফেরে।
কুড়িগ্রামের মেয়ে শারমীন আক্তার হীরা। ব্যবসায়ী বাবা মো. আবু হানিফ সরকার ও গৃহিনী মা সালেহা বেগম হরতালের কারণে আসতে পারেন নি, জমকালো অনুষ্ঠানে হীরার চমক দেখতে পারেন নি স্বচক্ষে। তবে টেলিভিশনের সামনেই বসে আছেন তারা- জানালেন শারমীন আক্তার হীরা।
লিজা আক্তার, সানজিদা বেগম মিতু, শাহরিনা ইসলাম, আইরিন আক্তার, বিলকিস, সোনিয়া, কেয়া, শাবানা, স্বপ্না, শেফা, বিউটি, জিনিয়া, চাঁদনি- সবাই সদ্য কৈশোর পেরুনো সৈনিক।
‘৩১ জানুয়ারির অপেক্ষায় আছি আমরা। যদি ছুটি পাই, বাড়ি যাব, সবাই আরও বেশি আদর দেবে’-একসঙ্গে ঝলমলিয়ে বলে ওঠেন।
নাম না প্রকাশের শর্তে প্রশিক্ষকদের একজন জানান, এই সৈনিকদের খুব পরিশ্রম ও ধৈর্যের বিষয়ে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, প্রতিটি মেয়ে নিজেকে একদমই মজবুত করে গড়েছে। এরা প্রত্যেকে বাংলাদেশের সম্পদ।
অপর সুপারভাইজার জানান, প্রথমে এক হাজার ছাত্রী নিয়ে শুরু হয়েছিল প্রশিক্ষণ। কিন্তু পরে স্বাস্থ্য, মেধার বিচারে কেউ কেউ বাদ পড়েছেন। আর কেউ কেউ বাদ পড়েছেন- এসএসসি, এইচএসসি’তে জীববিজ্ঞান পড়েনি বলে।
তিনি বলেন, এখন যারা আছে, তারা সবদিক দিয়েই দেশসেবায় প্রস্তুত, চৌকস। সেটা সেবায় হতে পারে, যুদ্ধ জয়েও হতে পারে।
উপস্থিত সুপারভাইজরদের মধ্যে অন্যজন জানান, এই ব্যাচের প্রশিক্ষণের সময় আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন এবং মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করেছেন নারী সৈনিকদের।
এই সুপারভাইজার আরও বলেন, আমেরিকাও এমন প্রশিক্ষণ দিয়েছে তাদের দেশে, তবে মাত্র ৩১৭ জনকে। কিন্তু আমরা শুরু করেছি হাজার জন নিয়ে। এটা আমাদের গর্বের আরেকটি কারণ।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৫