কক্সবাজার: মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। বয়স ৭৭ ছুঁই ছুঁই।
তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে কক্সবাজারের মানুষ তাকে চেনেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর, অনুরাগী ও ভক্ত হিসেবে। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে টানা ৫১ বছর পার করে দিয়েছেন মুজিব কোট গায়ে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, ঈদ আনন্দ, বিয়ের উৎসব যাই হোক না কেন, মুজিব কোট গায়ে থাকবেই।
ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নুরুল ইসলাম প্রথম মুজিব কোট পরেন ১৯৬৪ সালে। সেই থেকে আজ অব্দি চলছে। স্বপ্ন দেখেন, মুজিব কোট পরিহিত অবস্থায় যেন মৃত্যু হয় তার।
তার ভাষায়, ‘মৃত্যুর সময়ও মুজিব কোটটি যেন আমার গায়ে থাকে, এটিই আমার কামনা। ’
নুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, ১৯৬২ সালে তার সভাপতিত্বে কক্সবাজার আদালত মাঠে ন্যাশন্যাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (এনডিএফ) একটি সভা হয়। সেই সভায় সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান ও চট্টগ্রামের রাজনীতিক নবী চৌধুরী এসেছিলেন। সভা শেষে রাতে কক্সবাজার ‘সি বিচ’ রেস্ট হাউজে শেখ সাহেবের (বঙ্গবন্ধু) সঙ্গে একান্তে রাজনৈতিক আলাপ হয় তার। সেই আলাপেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এনডিএফ দিয়ে হবে না, আওয়ামী লীগ গঠন করতে হবে। একথা বলেই বঙ্গবন্ধু তার হাতে হাত রেখে প্রতিশ্রুতি আদায় করেন।
তারপর ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু কক্সবাজার আসেন। লালদীঘির মাঠে জনসভা হলো। সেদিনই প্রথম মুজিব কোট পরেছিলেন নুরুল ইসলাম। মুজিব কোট গায়ে দিয়ে যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মঞ্চে উঠলেন তখন বঙ্গবন্ধু নাকি মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘তোকে বেশ মানিয়েছে, সবসময় পরবি কিন্তু। ’
এই মঞ্চেই কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়। তিনি মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তারপর সেই মুজিব কোট আর ছাড়া হয়নি, জানান তিনি।
নুরুল ইসলাম বলেন, মুজিব কোট নিয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বার বার বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম।
এ ব্যাপারে তিনি জানান, তিনি তখন কক্সবাজার প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কক্সবাজার সফরে এলে প্রেসক্লাব সভাপতি হিসেবে সার্কিট হাউজে তার ডাক পড়েছিল। তিনি গিয়েছিলেন। কিন্তু গায়ে মুজিব কোট দেখে রাষ্ট্রপতির কয়েকজন সফরসঙ্গী হতবাক। তাকে বলা হলো, মুজিব কোট খুলে ফেলতে। কিন্তু তাতেও তিনি রাজি হননি।
পুরো অনুষ্ঠানে তিনি একাই ছিলেন মুজিব কোট গায়ে। ফলে সবারই দৃষ্টি ছিল তার উপর। মুজিব কোট দেখে রাষ্ট্রপতিও বার কয়েক তাকান তার দিকে।
আরেকবার রাজধানী ঢাকায় গণভবনে ডাক পড়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। সেবার দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য গিয়েছিলেন। জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে তাকে গাড়িতে তুলে নেওয়ার সময় আপত্তি উঠল মুজিব কোট নিয়ে। সংশ্লিষ্টরা তাকে অনুরোধ করলেন, মুজিব কোটটি খুলে গাড়িতে রেখে দিতে। কিন্তু তিনি শোনেননি।
মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করে নুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, তখন আমি থাকতাম কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে। পশ্চিমা হায়েনারা এলাকায় এসে গেছে। তাই আত্মগোপনে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। গায়ে মুজিব কোট। তার উপর শীতের চাদর গায়ে দিয়ে পথে বের হবো। সঙ্গে ছিলেন চকরিয়ার ইউপি চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা ও আমার স্ত্রীর বড় ভাই মোজাম্মেল হক। সবাই আমাকে অনুরোধ করলেন মুজিব কোট খুলে ফেলতে। কিন্তু আমি খুলিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির সময় ঢাকায় তোপখানা রোডের একটি হোটেলে ছিলেন নুরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর কারফিউ জারি করা হয়েছিল সেদিন। ১৫ আগস্ট জুমার নামাজের সময় কারফিউ শিথিল করা হয়।
এসময় তিনি হোটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন সাংবাদিক আবুল ফজল হাজারির বাসায়। সঙ্গে ছিলেন কক্সবাজারের যুবলীগ নেতা সালাউদ্দিন মাহমুদ। সালাউদ্দিন মাহমুদ অনেক আকুতি করলেন মুজিব কোট খুলে রাখার জন্য। কিন্তু তাও সম্ভব হয়নি। এমনকি সেদিন অনেক দলীয় নেতাই খুলে রেখেছিলেন মুজিব কোট। অনেকেই নাকি সেদিন তার সঙ্গে থাকা নিরাপদ নয় বলে তাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির এমন ক্রান্তিলগ্নেও গায়ে মুজিব কোট নিয়ে তিনি ঢাকা থেকে কক্সবাজার এসে পৌঁছান।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসা এতটাই প্রবল যা পরিবারের সদস্যদের অনুপ্রাণিত করেছে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি হওয়ার।
নুরুল ইসলামের মেজছেলে শহর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নজিবুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, জন্মের পর থেকেই বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো দেখেছি বঙ্গবন্ধুর ছবি। বাবাকে দেখেছি মুজিব কোট পরে চলাফেরা করতে। বাবার কাছেই জানতে পেরেছি জাতির জনকের আর্দশ সম্পর্কে।
শুধু তিনি নন, তার বড় এবং ছোটভাইও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
দৈনিক কালের কণ্ঠের কক্সবাজার অফিস প্রধান সাংবাদিক তোফায়েল আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমার সাংবাদিকতার গুরু মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। তার সঙ্গে প্রায় দুই যুগ কাজ করেছি। কখনও তাকে মুজিব কোট ছাড়া দেখিনি।
কক্সবাজার শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, সততা আর আর্দশের আরেক নাম নুরুল ইসলাম। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত সৈনিক। যিনি কখনও ভয় পেয়ে আওয়ামী লীগ কিংবা জাতির পিতাকে ছেড়ে যাননি। এমনকি তার আর্দশ অনুপ্রাণিত করেছে তার পরিবারের সদস্যদেরও।
প্রয়াত নেতা ফণিভুষণ মজুমদার যখন বাংলাদেশ কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তখন মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম ছিলেন দলের পলিটব্যুরো সদস্য। তিনি বর্তমানে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি। আশির দশকে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়ন পরিষদে দুইবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশ সময়: ২১০২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৫
এসএস