ঢাকা: দল এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত জাতীয় পার্টির নেতারা। কেউ কেউ দল ছাড়তে চাইছেন।
এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বয়স বেড়ে যাওয়া। নেতারা অনেকেরই আশঙ্কা, এরশাদের অবর্তমানে পার্টিতে নেতৃত্বের চরম সংকট দেখা দিতে পারে। কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়বে দলটি। আর এমনটি হলে নামসর্বস্ব পার্টিতে পরিণত হবে ‘ওয়ানম্যান শো’ নামে খ্যাত জাতীয় পার্টি।
সামরিক শাসকের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পাওয়া জাতীয় পার্টি শুরু থেকেই এরশাদকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়ে আসছে। দু’একবার যারাই এরশাদের সিদ্ধান্তে দ্বিমত করতে গেছেন তাদের দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক নেতা একাধিক দফায় শোকজ নোটিশ পেয়েছেন বা সাময়িক বহিষ্কারের শিকার হয়েছেন। শোকজের ক্ষেত্রে এরশাদ ছাড় দেননি আপন ভাই জিএম কাদের ও সহধর্মিনী বেগম রওশন এরশাদকেও।
গণঅভ্যত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত এই দলটির নানা চড়াই উৎরাই পাড়ি দিতে হয়েছে। কয়েক দফায় ভাঙ্গন আর নেতাদের দল ছেড়ে যাওয়া কারণে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে দলটি। ভোটের সমীকরণেও দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। আসনের সংখ্যায় কিছুটা হেরফের হলেও ভোটের সূচক দিনকে দিন কেবলই নিম্নগামী।
গণআন্দোলনের মুখে বিদায়ের পর ১৯৯১ সালে নির্বাচনে যতো ভোট পড়েছিল তার ১১.৯২ শতাংশ পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ১০.৬৭ শতাংশ, আর ২০০১ সালের ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রণ্টের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা ভোট পেয়েছে ৭.২৫ শতাংশ। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে পেয়েছে মাত্র ৭.০৪ শতাংশ। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন অংশ নেয়। কিন্তু যে আসনেই জোট ছাড়া নির্বাচন করেছে সেখানেই ধরাশায়ী হয়েছেন দলটির প্রার্থীরা।
জাতীয় পার্টির দুর্গ বলে খ্যাত রংপুর ও গাইবান্ধার তিনটি আসনেও বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছেন দলটির হেভিওয়েট প্রার্থীরা। রংপুর-৪ (পীরগাছা-কাউনিয়া) আসনে আওয়ামী লীগ নেতা টিপু মুন্সীর কাছে পরাজিত হন টানা কয়েকবারের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির ডোনার বলে খ্যাত আরকে গ্রুপের কর্ণধার প্রেসিডিয়াম সদস্য করিম উদ্দিন ভরসা।
অন্যদিকে রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনে আওয়ামী লীগ নেতা এইচএন আশিকুর রহমানের কাছে পরাজিত হন আরডি গ্রুপের কর্ণধার আখম জাহাঙ্গীর হোসেন।
রংপুরের পর গাইবান্ধাকে ধরা হয় জাতীয় পার্টির দ্বিতীয় দুর্গ বলে। সেখানেও জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার কাছে পরাজিত হন জাপার সেকেন্ড ইন কমান্ড বলে খ্যাত সাবেক ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদ। একই সঙ্গে কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম আসনে ধরাশায়ী হন সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য সদ্যপ্রয়াত কাজী জাফর আহমেদ। এসব পরাজয় ও ভোটের হার কমে যাওয়া জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তায় ধস নামার আলামত বলে মনে করেন অনেকে।
তবে চেয়ারম্যান এরশাদ একথা মানতে নারাজ। তিনি একাধিক জনসভায় বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টির জনসমর্থন আগের চেয়ে বেড়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মাত্র ৪৯ টি আসনে নির্বাচন করেছি। এসবের মধ্যে মাত্র ৩৪ আসনে জোটগতভাবে নির্বাচন হয়েছে। এতে ২৭টি আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে। আর কোনো দল এমন সাফল্য পায় নি।
এরশাদ যাই বলুন, তাঁর দলের নেতাকর্মীরাও তার এই কথা অন্তরে লালন করেন না। অন্তত গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভরাডুবি (একটিমাত্র চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হওয়া) এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ে তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
পরাজয়ের পাশাপাশি কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত গ্রুপিংয়ে উদ্বিগ্ন নেতাকর্মীরা। কোনোভাবেই গ্রুপিং ঠেকাতে পারছেন না এরশাদ। খোদ তার সহধর্মিনী রওশন এমনই একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওই গ্রুপটি ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
রওশনপন্থী নেতাদের অনেক বার ডেকেও সাড়া পাচ্ছেন না এরশাদ। এরশাদ হুমকি দিয়েছিলেন, দলে না ফিরলে তাদের পরিণতি ভালো হবে না। এমনকি আগামী নির্বাচনে লাঙল পেতে হলে তার (এরশাদ) কাছেই আসতে হবে। তাতেও কাজ হয় নি। এখনও এরশাদের ডাকা বৈঠকের চেয়ে রওশনের ডাকা বৈঠকেই এমপিদের উপস্থিতি বেশি দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে দিন দিন ব্যবধান বাড়ছে এরশাদ ও রওশনপন্থী ধারায়। এরশাদের কর্মসূচিতে রওশন যান না। আবার রওশন নিজেও পৃথকভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে যেসব সংবাদ সম্মেলন করেন তাতেও এরশাদ উপস্থিত হন না। রওশনকে চাপে রাখতে তাঁর গ্রুপের সেকেন্ড ম্যান বলে খ্যাত তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন এরশাদ। তাতেও কোনো ফল হয় নি। অগত্যা বাধ্য হয়ে অব্যাহতিপত্র তুলে নিয়েছেন এরশাদ।
অন্যদিকে গ্রপিংয়ে ব্যস্ত নেতারা এরশাদের উপস্থিতিতেই ঘটনা নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন। এসব কারণে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত তৃণমুল পর্যায়ের নেতারা।
সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে এরশাদের বয়স ইস্যু। গত নির্বাচনের আগে এরশাদ নিজেই বলেছিলেন, ‘আমার বয়স হয়েছে। এরপরে হয়তো আর নির্বাচন করা হবে না। ’
এরশাদের নিজের ভাষায়, ৮৮ বছরে পা রেখেছেন তিনি। ইদানীং খুব ঘনঘন অসুস্থ বোধ করছেন। শারিরিক কারণে সড়কপথে যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছেন। এ-কারণে ঢাকার বাইরে দলীয় কর্মসূচিতে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না তাকে।
ইদানীং এরশাদের উপস্থিতিতেই প্রায়শই প্রশ্ন উঠছে, তাঁর উত্তরসূরী কে হবেন। এরশাদও পরিষ্কার করে কিছু বলছেন না। যুব সমাজের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘তোমরাই আমার উত্তরসূরী। তোমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে জাতীয় পার্টি। আর জাতীয় পার্টি বেঁচে থাকলে আমি কবরে থেকেই শান্তি পাব। ’
কিন্তু এরশাদের এই জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না নেতারা। তারা বলেছেন, এরশাদের বর্তমানেই দলেই মধ্যে একাধিক ধারা বিরাজমান। এরশাদের অবর্তমানে কি হবে ভেবে কূল পাচ্ছেন না তাঁরা। এ-কারণে নেতারা তাদের নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। অনেকেই গোপনে যোগাযোগ করছে অন্য দলের সঙ্গে। উপযুক্ত সময়-সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। হাওয়া যেদিকে বইবে সেদিকে হাল ধরতে চান।
এছাড়া দলে কোনো অবদান না রেখেও অনেকে ডাবল-ট্রিপল প্রমোশন পাওয়ায় ত্যাগী নেতাকর্মীরা হতাশ। আর হতাশা থেকেই কেউ কেউ নিষ্ক্রিয়। আবার বিগত নির্বাচনের সময় থেকে নির্বাচনপন্থী ও নির্বাচনবিরোধী দু’টি গ্রুপ সক্রিয় । গত সংসদ নির্বাচনে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বর্জন করেন এরশাদ। আর রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একাট্টা হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন বেশিরভাগ নেতা।
নির্বাচনপন্থী আর নির্বাচন বর্জনকারীরা দুই ধারায় বিভক্ত। নির্বাচন বর্জনকারীরা অংশগ্রহণকারিদের সুবিধাবাদী ও বেইমান বলে আখ্যায়িত করেন। নির্বাচনকালে অনেক বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে। এ-কারণে কেউ কাউকে আর সহ্য করতে পারেন না।
সম্প্রতি এক সভায় এরশাদ বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় নি, জনপ্রিয়তা বরং বেড়েছে। এই মহুর্তে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টিকে কখনই স্বাধীনভাবে নির্বাচন করতে দেওয়া হয়নি। সব সময় ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্ব ০৪, ২০১৫
এসআই/জেএম