পাবনা: চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে পাবনা ভাঁড়ারা গ্রাম এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে।
শনিবার (১১ ডিসেম্বর) নৌকা ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে খুন হন ভাঁড়ারা গ্রামের ইয়াসিন আলম নামে আনারস প্রতীকের এক স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী।
একপক্ষ ধারাবাহিক ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা অপরদিকে আরেক পক্ষ দীর্ঘদিনের একছত্র ক্ষমতার অবসান ঘটিয়ে নতুন নেতৃত্বে আসার প্রচেষ্টায় সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটেই চলছে। একদিকে বিচারহীনতায় আতঙ্কের মধ্যে খুন হওয়া পরিবারের সদস্যরা। আরেক দিকে চলমান এই রাজনৈতিক ও দলগত হামলা-মামলার কারণে আতঙ্কগ্রস্ত এলাকার সাধারণ মানুষ। তাই দীর্ঘদিনের এই প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি থেকে অবসান চান স্থানীয়রা।
পাবনা সদরের খুব কাছের ইউনিয়ন ভাঁড়ারা। ইউনিয়নের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মানদী আর মাঝখানে বিশাল চরাঞ্চল। এই অঞ্চলের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ এই খুনের রাজনীতির কারণে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না। আবার কখন প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা হামলা করে তাদের গ্রামগুলোতে। উভয়পক্ষের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা ও রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে সদস্যরা মামলা করলেও ক্ষমতা আর অর্থের কাছে পরাজিত হচ্ছে বারবার। এ কারণে এ এলাকায় ঘটছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া।
এবারের নির্বাচনী সহিংসতায় স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ইয়াসিন আলম (৪০) একজন খুন হন। তাই ভাঁড়ারা ইউপিতে আগামী ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। এই সংঘর্ষের ঘটনায় আরো ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পাবনা জেনারেলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনার দিন রাতে নিহত চেয়ারম্যান প্রার্থী ইয়াসিন আলমের বাবা মোজাম্মেল হোসেন নিজে বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
নিহত ইয়াসিন আলমের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করে বলেন, চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খান অবৈধভাবে ক্ষমতার দাপটে আজ মানুষ খুন করছেন। গ্রামের অর্ধশত পরিবার তাদের সন্তান হারিয়েছে। শতশত মানুষ নারী-পুরুষ আহত হয়েছেন। তার বিপক্ষে গেলেই তারা আক্রমণ করে হামলা করে খুন করে। আমরা পরিত্রাণ চায় সাঈদের হাত থেকে। বিচার চাই, ফাঁসি চাই তার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজাকার পরিবারের সদস্য চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খান। তারা বাবা পিচ কমিটির সদস্য ছিলেন। আর আজ তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ সেজে দেশের প্রকৃত দলের লোজনকে খুন করছেন। এখন পর্যন্ত কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। আমরা সাধারণ মানুষ ভয়ে ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি।
নিহত ইয়াসিন আলমের বাবা মামলার বাদী মোজাম্মেল হোসেন খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘কী বলবো আর কী হবি। একের পর এক হত্যা খুন হামলা ভাঙচুর নির্যাতন করছেন চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খান ও তার ভাই পাশ্ববর্তী দোগাছি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী আলতাব হোসেন খান। নদী থেকে বালু তুলে টাকার পাহাড় করেছেন তারা দুই ভাই। হত্যা মামলার আসামি হয়েও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় তারা। রাজাকারের সন্তানের হাতে আজ দলের লোকজন জিম্মি হয়ে রয়েছে। আমার ছেলে, ভাই, ভাতিজা হত্যাসহ এলাকার সবাই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। ’
জেলা পুলিশের অতিরিক্তি পুলিশ সুপার সদর সার্কেল মো. রোকুনুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে ভাঁড়ারা ইউনিয়নের দু’পক্ষের মধ্যে ঝামেলা হয়ে একজন খুন হয়েছে। শনিবার মধ্যরাতে নিহত ইয়াসিন আলমের বাবা বাদী হয়ে চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খানকে প্রধান করে ৩৪ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার অভিযোগের বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত করে মামলার এজহারনামীয় দুইজনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে। মামলার আসামিদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চলছে বলে জানান তিনি।
১১ ডিসেম্বর শনিবার সকালে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী (ঘোড়া মার্কা) সুলতান মাহমুদের সমর্থকরা নির্বাচনী প্রচারণায় বের হন। এ সময় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খানের লোকজন তাদের ওপর হামলা করে বলে অভিযোগ করেন। এ সময় সুলতান মাহমুদের চাচাতো ভাই স্বতন্ত্র আনারস প্রতীকের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ইয়াসিন আলমকে কুপিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা। এ সময় উভয়পক্ষের অন্তত ২০ জন গুরুতর আহত হন। রাজশাহী নেওয়ার পথে নাটোরের বনপাড়া পৌঁছালে মারা যান ইয়াসিন আলম।
এ ঘটনার পরে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এজহার নামীয় দুইজনকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে। মামলার প্রধান আসামিসহ সকলকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চলছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা। এই ভাঁড়ারা ইউনিয়নের রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় এখন পর্যন্ত খুন হয়েছে প্রায় ৪৭ জন। তবে কোন মামলায় এখনো বিচার নিষ্পত্তি হয়নি। এলাকার সাধারণ মানুষ নিস্তার চায় এই হত্যার রাজনীতি থেকে। বিচার চায় খুন হওয়ার পরিবারের সদস্যরা।
বাংলাদেশ সময়: ২১২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০২১
এনটি