ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

সুদিনেও অবহেলিত আদিতমারীর প্রবীণ আ.লীগ নেতারা

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৩ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০২২
সুদিনেও অবহেলিত আদিতমারীর প্রবীণ আ.লীগ নেতারা ইশা খাঁন বিদা ও আব্দুল গফ্ফার

 

লালমনিরহাট: নব্যদের ভিড়ে নিরবে হারিয়ে যাচ্ছেন লালমনিরহাটের তৃণমূল আওয়ামী লীগের এক সময়ের দাপুটে নেতারা।  

দুর্দিনের হাতিয়ার ত্যাগী নেতারা সুদিনে অযত্ন আর অবহেলায় হারাতে বসেছেন জীবন প্রদীপ।

জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ তথা পরবর্তী সময়ে নানা কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত উত্তরাঞ্চলের ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা জেলা লালমনিরহাট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বিএনপি ও জাতীয় পার্টির দখলে চলে যায় জেলার রাজনীতি। সেই সময় কর্মী সংকটে বেশ বেকায়দায় পড়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর টানা ৩০ বছরের বেশি সময় জাতীয় পার্টির (জাপা) একক আধিপত্যে ঘেরা ছিল জেলার রাজনৈতিক অঙ্গন। বিশেষ করে লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনটি টানা ৩৬ বছর জাপা নেতা মজিবর রহমানের দখলে ছিল। এ এমপির মৃত্যুর পর পরিস্থিতি বদলেছে।  

সেই সময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের হাতে গোনা কয়েকজন নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কর্মী কম থাকায় নানা নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করে দলীয় কর্মসূচি সফল করতেন তারা। নিজের জমি আর গোলার ধান-পাট বিক্রি করে রাজনীতি করা এসব নেতাকর্মী বর্তমানে নিদারুন অর্থকষ্টে ভুগলেও কেউ খবর নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ তাদের।

প্রবীণ নেতাকর্মীরা জানান, জাতীয় পার্টি আর বিএনপির চাপে চরম নির্যাতিত হয়েও নৌকার সমর্থনে কাজ করেছেন। দলের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি তারা। শুধুমাত্র আওয়ামীলী গ করার কারণে জীবনের মূল্যবান সময় জেলখানা আর বাড়ি ছাড়া হয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। সব থেকে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এরশাদ হটাও আন্দোলনে। জাপার ঘাঁটিতে নৌকা ভিড়াতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে তাদের। কোনো একদিন আওয়ামী লীগের সুদিন এলে মূল্যায়িত হবেন- সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিবারকে সান্ত্বনা দিতেন তারা।
আজ সারাদেশে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার, সুদিন ফিরেছে। তাই নেতাকর্মীর অভাব নেই দলটিতে। এক সময়ের কঠোর বিরোধীরাও আওয়ামী লীগে চেপে বসে বড় বড় পদ দখলে নিয়েছেন। তাদের ভিড়ে অবহেলিত সেই সময়ের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। অসুস্থ হয়ে বিছানায় মৃত্যুর প্রহর গুণলেও কোনো নেতাকর্মী তাদের খবর রাখেন না। চিকিৎসার জন্য সহায়তার আবেদন করেও সুফল পাননি কেউ কেউ। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে নিরবে বিছানায় মৃত্যুর প্রহর গুণছেন অনেকে।

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের আব্দুল গফ্ফার। এরশাদ হটাও আন্দোলনের সময় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বর্তমানে অনুপ্রবেশকারীদের ভিড়ে ডুবে গেছে তার নাম ডাক। বাধক্য তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। নিজের ও স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সহায়তা চেয়ে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেও সহায়তা মেলেনি। শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের চাকরির জন্য হন্নে হয়ে ঘুরেও চাকরি যোগাতে পারেননি।

তিনি বলেন, কর্মী কম থাকায় তখন নৌকার মিছিল বের করলে সবাই হাসাহাসি করত। হামলা চালাত জাতীয় পার্টি আর বিএনপির ক্যাডাররা। আজ সেই হামলাকারীরাই দলের বড় বড় পদে বসেছে। তাদের কাছে গেলে সহায়তা তো দূরের কথা, সম্মানটুকুও মেলে না। বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য হিসেবে রাখলেও কেউ খবরটুকুও নিচ্ছে না, মরে গেছি না কি জীবিত আছি? 
একই অবস্থা তার সহযোদ্ধা ইশা খান বিদারও। নিজ দলে কর্মী বাড়াতে পকেটের টাকায় হাট বাজার মাঠ ঘাট চায়ের দোকানে ক্যাম্পেইন করতেন। তিনি আজ প্যারালাইজড হয়ে বিছানায়। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা স্ত্রী মরিয়ম সুলতানার চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়ে একাধিকবার আবেদন করেছেন। ছেলেকে কয়েক দফায় সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। অনেকে চিকিৎসা সহায়তার চেক পেলেও প্রবীণ আওয়ামী নেতার স্ত্রীর চিকিৎসায় একটি টাকাও সহায়তা মেলেনি।  

তার ছেলে শাওন খান রাজিব বলেন, টাকা না পেয়ে শূন্য হাতে ফিরে চাষাবাদের জমিটুকু বন্ধক রেখে মায়ের হার্টে রিং পরিয়েছি।  

১৯৮৭-৯৭ পর্যন্ত আদিতমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। যিনি এরশাদ হটাও আন্দোলনে বাড়ি ছেড়ে বাঁশঝাড়ে রাত কাটিয়েছেন। জুলুম মামলা হামলার শিকার হয়েছেন। আজ তিনিও আর্থিকভাবে পঙ্গু। তারও কোনো খবর রাখে না বর্তমান নেতাকর্মীরা।  

তিনি বলেন, এরশাদ হটাও আন্দোলনে একটি রাতও বাড়িতে ঘুমাতে পারিনি। মশার কামড়ে শরীরে ঘা হয়েছিল। সেই সময়ের জাতীয় পার্টির ক্যাডারা আজ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের চারপাশে বসে থাকেন। আমাদের কথা শোনার সময়ও তো তাদের নেই।

১৯৯০-৯৭ পর্যন্ত আদিতমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক মাহবুবার রহমান ফারুক বলেন, এরশাদ হটাও আন্দোলন আর বিএনপি বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় একটি রাতও বাড়িতে থাকতে পারিনি। একেক দিন একেক আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটিয়েছি। আজ দলে অনেক লোক। কিন্তু ত্যাগীরা নেই। সময় এসেছে তাদের খুঁজে বের করে কৃতজ্ঞতা জানানোর। তা করলে ত্যাগী নেতাকর্মীরা মরে গেলেও শান্তি পাবেন।

১৯৮৫ - ৯০ পর্যন্ত আদিতমারী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এবং ৯০-৯৭ সাল পর্যন্ত উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক বাবু নীল কমলও সুদিনে বঞ্চিত। তিনি ১৯৮৮ সালে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামুড়ি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের জনসভায় বিশেষ অতিথি ও আয়োজক ছিলেন। গেল ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক চেয়েও বঞ্চিত হয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালে নামুড়ি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জনসভা করেছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সময় এরশাদ হটাও আন্দোলনে জেলা-উপজেলার নেতারা কারাবন্দী থাকায় সভানেত্রীর জনসভায় যুবলীগের সভাপতি হিসেবে আমি আয়োজক ছিলাম। সভানেত্রী প্রধান অতিথির বক্তব্য রেখেছিলেন। আমি বিশেষ অতিথির। ওই দিন নেত্রী বলেছিলেন, দেশের মানুষ এক সময় আমাদের (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় বসাবে। তখন কোনো সংকট থাকবে না। কষ্ট হলেও দলকে গুছিয়ে নাও। নেত্রীর নির্দেশে কঠোর পরিশ্রম করেছি। আজ নেত্রীর কথা বাস্তব হয়েছে, মানুষ ঠিকই আমাদের দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সুদিনে হাইব্রিডদের ভাগ্য ফিরলেও ভয়াল দিনের ত্যাগী নেতাকর্মীরা আজও অবহেলিত।

যাদের ত্যাগে আজ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত, সুদিনে তাদের মূল্যায়ন করা হবে এমনটাই প্রত্যাশা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০২২
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।