ঢাকা: বেসরকারি কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উদপাদন ও সরবরাহ না করেই প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এভাবে গত কয়েক বছরে তারা লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে গেছে।
শুক্রবার (২৯ জুলাই) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিদ্যুতের লোডশেডিং ও জ্বালানি খাতে অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি আয়োজিত বিক্ষোভ-সমাবেশে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ২০২১-২২ অর্থ বছরে বিদ্যুৎ খাতে লোকসান হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। এমনি গত কয়েক বছরে সব মিলিয়ে লোকসান লক্ষ-কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বেসরকারি কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করে না, বিদ্যুৎ দেয়ও না। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জের টাকা নিয়ে চলে যায়। কারা এই টাকাগুলো নিয়েছে জানেন? সামিট গ্রুপ এক বছরে নিয়েছে ৯ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল ৬ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা, এরদা পাওয়ার হোল্ডিং ৬ হাজার ৭২০ কোটি টাকা, ইউনাইটেড গ্রুপ ৪ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা, কেপিসিএল ৩ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এই রকম ১০টা কোম্পানি যারা এই আওয়ামী লীগের সঙ্গে, মন্ত্রীদের সঙ্গে, শেখ হাসিনার সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত তারা এই হাজার হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই নিয়ে চলে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এই বিদ্যুৎ আনার জন্য সরকার কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো নিয়ে এসেছিল কোনো টেন্ডার না করেই হাজার হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয়ে। এটার জন্য কোনো মামলা হবে না- ইনডেমনিটি আইন তৈরি করেছে। এই আওয়ামী লীগ সরকার, শেখ হাসিনার সরকার -এদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে লুটপাট ও দুর্নীতি করা। কয়েকদিন আগে দেখলেন পদ্মা সেতু খুব ফলাও-টলাও করে উদ্বোধন ঘোষণা করলো। ১০ হাজার কোটি টাকার ব্রিজ তারা ৩০ হাজার কোটি টাকায় করলো। একই ভাবে দেখবেন গত ১০ বছর ধরে চলছে এই যে মাথার উপরে (জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মেট্রারেল পথ) মেট্রোরেল। উত্তরায় এখন যাওয়া যায় না। সেখানের ভিআইপি রাস্তায় গেলে আপনাকে ২/৩ ঘণ্টা হাতে নিয়ে যেতে হবে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে সুরঙ্গ ব্রিজ করছে। আর অন্যদিকে সাধারণ মানুষের খাওয়ার টাকা নেই। কালকে টেলিভিশনে দেখেছি আপনারা যতই এই সমস্ত টানেল আর মেগা প্রজেক্ট তৈরি করেন আমার দেশের ৪২ ভাগ মানুষ এখনো দুই বেলা খেতে পায় না। তাদেরকে আজ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, অর্থমন্ত্রী (আহম মুস্তফা কামাল) বললেন যে, আমরা আইএমএফ থেকে টাকা ধার নেব না। আমরা এখন শক্তি বাড়াচ্ছি অর্থনীতির মধ্যে। কালকে পত্রিকায় দেখলাম যে তারা সাড়ে চারশ বিলিয়ন ডলার ধার চেয়েছে আইএমএফের কাছে। আপনারা দেখবেন যে, এই সরকার মুখে সমস্ত বড় বড় কথা বলে, অনর্গল মিথ্যা কথা বলে, মানুষকে প্রতারণা করে, মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা শূণ্য হয়ে গেছে বন্ধুরা- মানে একেবারে যে আমি গরীব। ফোকলা দেশে পরিণত করেছে।
দেশের অর্থনীতির অবস্থা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশে এখন ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার। এই ৩১ বিলিয়ন ডলার সঠিক নয়। এখানে ৮/৯ কোটি ডলার আছে সোনা। আর শুধু ব্যবহার করা যায় এর পরিমাণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ১৬ বিলিয়নের বেশি নয়। আজকে এই সরকার পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধবংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। সুতরাং এদেরকে আর কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না, আর কোনো সময় দেওয়া যাবে না। বেশিক্ষণ এরা ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশকে ধবংস করে ফেলবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, বৃহস্পতিবার তিনি (ওবায়দুল কাদের) বলেছেন, দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির কোনো ঘাটতি নেই। আমার প্রশ্ন ঘাটতি নেই তো লোডশেডিং কেন, ঘাটতি নেই তো ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ নেই কেন? কেন আপনারা জ্বালানি রেশন করছেন? কেন আজকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন অশনি সংকেত? আজকে দুর্নীতি করে, চুরি করে তারা (সরকার) বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে সর্বনাশ করে দিয়েছে। আজকে শহরে দুই-তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ যায়। আর গ্রামে ৭/৮ ঘণ্টা কোনো বিদ্যুৎ থাকে না। অথচ এই সরকার এই বিদ্যুৎ খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাঠিয়েছে।
সমাবেশে আসা নারী নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, পত্রিকায় দেখলাম ব্যর্থ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে পুলিশের গুলিতে ছয় মাসের শিশু সুরাইয়ার মাথার খুলি উড়ে গেছে। পত্রিকা খোলেন, প্রতিদিন দেখবেন হাজারো মানুষ হয় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে, অথবা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নির্যাতনে মারা যাচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের শ্লীলতাহানি হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছে। সারাদেশে আজকে হাহাকার পড়ে গেছে।
এর সঙ্গে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়েছে বিদ্যুৎ নেই। আমাদের মা-বোনেরা এখানে হারিকেন নিয়ে এসেছেন। এই হারিকেনটা গণভবনে শেখ হাসিনার কাছে পাঠিয়ে দেন। তার হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেন। শুধু এই মিটিংয়ের মধ্যে হারিকেন আনলে হবে না। যখনই অন্ধকার আসবে, যখন লোডশেডিং শুরু হবে, আপনারা মোমবাতি ও হারিকেন নিয়ে বের হবেন। এই মোমবাতি হারিকেন নিয়ে না বের হলে আমরা আলোচিত হব না।
সমাবেশের শুরুতে দেশ রুপান্তর সম্পাদক অমিত হাবিবের মৃত্যুতে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা জানান বিএনপি মহাসচিব। সকাল ৯টা থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সমাবেশ চলছিল। বেলা ১১টায় অমিত হাবিবের কফিন প্রেসক্লাবের সামনের আঙিনায় জানাজার জন্য আনা হলে বিএনপির সমাবেশ ১০ মিনিট স্থগিত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয় মঞ্চ থেকে। সমাবেশে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে প্রতিবাদ জানাতে নারী কর্মীদের হারিকেন হাতে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। মূল মঞ্চেও ঝুলিয়ে রাখা হয় একটি হারিকেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব আমিনুল হকের সঞ্চালনায় সমাবেশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়াপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবদুস সালাম, কেন্দ্রীয় নেতা ফজলুল হক মিলন, আবদুস সালাম আজাদ, তাবিথ আউয়াল, সাইফুল আলম নিরব, যুবদলের মামুন হাসান, মোনায়েম মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক দলের মোস্তাফিজুর রহমান, সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, মহিলা দলের সুলতানা আহমেদ, হেলেন জেরিন খান, কৃষক দলের হাসান জাফির তুহিন, শহিদুল ইসলাম বাবুল, জাসাসের জাকির হোসেন রোকন, মৎস্যজীবী দলের আবদুর রহিম, ছাত্রদলের কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবন, সাইফ মাহমুদ জুয়েল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০২২
এমএইচ/এমএমজেড