ঢাকা: একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে সশস্ত্র অবস্থান নেওয়ায় দেশ স্বাধীনের পরে নিষিদ্ধ হয় জামায়াতে ইসলামী। পরবর্তীতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৯ সালে পুনরায় রাজনীতির সুযোগ পায় তারা।
শনিবার (২৭ আগস্ট) কুমিল্লার রুকনদের উদ্দেশে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের ভার্চ্যুয়ালি দেওয়া এক বক্তব্যে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে।
তার ওই বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে দুই দলের মধ্যে যে আর সুসম্পর্ক নেই, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে সেই আলোচনা আরও জোরদার হয়েছে।
ওই ভিডিওতে জামায়াত আমির বলেন, ‘আমরা এতদিন একটা জোটে ছিলাম। ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন, কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়েছিল। সেটা আর ফিরে আসেনি। ’
তিনি আরও বলেন, ‘বছরের পর বছর এ ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দল যারা আছে, বিশেষ করে প্রধান দলের (বিএনপি) এই জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তা নেই। বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট দিবালোকের মতো এবং তারা আমাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন বাস্তবতা হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর ওপর ভর করে পথচলা। তবে হ্যাঁ, জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো ইনশাল্লাহ। ’
বিএনপির সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি। তারা ঐকমত্য পোষণ করেছে। তারা আর কোনো জোট করবে না। এখন যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করব। যদি আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করেন, তাহলে আগামী দিনগুলোতে কঠিন প্রস্তুতি নিতে হবে। অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। দোয়া করেন, এসব ত্যাগ যেন আল্লাহর দরবারে মঙ্গলজনক হয়। এ ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ পাক যেন আমাদের পবিত্র একটি দেশ দান করেন। যে দেশটা কোরআনের আইনে পরিচালিত হবে। ’
এছাড়া ভিডিওতে ‘বিএনপি শরিয়া আইনে বিশ্বাস করে না’ বলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি বক্তব্যে হতাশ হওয়ার কথা বলেন জামায়াত নেতা।
জামায়াতের অতি সহিংসতায় সম্পর্ক দু'দিক করেছে: দশম সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্ত নেতাদের বিচার বন্ধ করতে আন্দোলনে নামে জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে বিএনপি মাঠে থাকলেও স্বাধীনতা বিরোধী অপরাধের বিচারে মাঠে ছিল না।
তখন বিএনপি নেতারা নানাভাবে জামায়াতকে ব্যাপক সহিংসতায় অভিযুক্ত করেন। সেই সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপরও হামলায় অভিযুক্ত করা জামায়াতে ইসলামীকে। এসব নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল বিএনপি।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের নেতাদের বাঁচাতে মাঠে না নামার বিএনপিকে দোষারোপ করেন।
স্বাধীন দেশে জামায়াতের উত্থান জিয়ার হাতে: বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে ধর্মকে ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর। ১৯৭৬ সালের ৩ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ এস এম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। তখন সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থাকলেও ক্ষমতার মূল চাবি ছিল জিয়াউর রহমানের হাতে।
এরপর জামায়াতে ইসলামীর আত্মপ্রকাশ করা ছিল শুধুই সময়ের ব্যাপার। কিন্তু জামায়াত ইসলামী সঙ্গে সঙ্গে আত্মপ্রকাশ না করে কিছুটা কৌশলী ভূমিকা নেয়। এজন্য তারা ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দল বেছে নেয়।
১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী এবং আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল মিলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গঠন করে।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও পরবর্তীতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান আইডিএলের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতাকে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেন। সে নির্বাচনে ছয়টি আসনে জয়লাভ করে জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে প্রথমবারের মতো ঢোকার সুযোগ পায়।
পরে ১৯৭৯ সালের ২৫, ২৬ এবং ২৭ মে ঢাকার ইডেন হোটেলে সম্মেলনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে নিজ নামে কর্মক্রম শুরু করে।
এরপর সেনাশাসক এরশাদ ক্ষমতায় এলে দুই দলের মধ্যে দৃশ্যমান ঐক্য ও অনৈক্য কোনটাই লক্ষ্য করা যায়নি।
খালেদা জিয়ার হাত ধরে জামাতের সঙ্গে অলিখিত জোট: জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোটের আলোচনা হয়েছিল ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেই। জামায়াত নেতা মুজিবুর রহমানের লেখা একটি বইয়ে উল্লেখ আছে, তারা সে সময় ১০০টি আসন চেয়েছিল বিএনপির কাছে। কিন্তু খালেদা জিয়া রাজি না হওয়ায় জোট আর হয়নি। পরে অঘোষিতভাবে ৩৫টি আসনে জামায়াতকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিনিময়ে তারাও দেশের বাকি আসনগুলোতে বিএনপির হয়ে কাজ করেছে।
এরপর বিএনপির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির আন্দোলনে জামায়াত ইসলামী মাঠে নামলে সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়। ১৯৯৬ সালে বিএনপি ও জামায়াত পুরোপুরি আলাদা নির্বাচন করে। তখন ভরাডুবি হয় জামায়াতের। তারা জেতে মাত্র তিনটি আসনে। অন্যদিকে বিএনপিও এ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়। ফলে বিএনপি ও জামায়াত দুই পক্ষই একে অন্যের গুরুত্ব বুঝতে পারে।
আনুষ্ঠানিক জোটে বিএনপি-জামায়াত: তারপর ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলনে অন্য দুই দলসহ চারদলীয় জোট গঠন করে জামায়াত-বিএনপি। সঙ্গে ছিল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং আজিজুল হকের ইসলামী ঐক্যজোট।
চারদলীয় জোট গঠনের অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথমে এরশাদ এবং পরে আজিজুল হক জোট ছেড়ে দেন। তবে সমালোচনার মধ্যেও জামায়াতকে বিএনপি কখনো ছাড়তে রাজি হয়নি।
জোট গঠনের দুই বছর পরে ২০০১ সালে যে জাতীয় নির্বাচন হয়, তাতে এই জোট দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে। যার কারণ হিসেবে মনে করা হয় বিএনপি-জামায়াত দুই দলের ভোট যোগ হওয়াকে।
তবে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধী বিরোধী আন্দোলনে এ জোট বিপাকে পড়ে। নির্বাচনে ভরাডুবি হয় এই জোটের। জামায়াতকে সঙ্গী করে বড় ব্যবধানে হেরে যায় বিএনপি।
২০০৮ নির্বাচন নিয়ে পরবর্তীতে বিএনপির পক্ষ থেকে ১০টি কমিটি গঠন করা হয় পরাজয়ের কারণ চিহ্নিত করতে। বিএনপির তৃণমূল নেতাদের বরাতে ৯টি কমিটিই জামায়াতকে দায়ী করে।
নির্বাচনের পর বিএনপির তরুণ নেতারাও প্রকাশ্যেই দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে দাবি তোলেন জোট ছাড়ার।
জামায়াতেও ক্ষোভ: মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতাদের বিচারের সময় বিএনপির কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতাও পায়নি বলে দলটির অভ্যন্তরে ব্যাপক ক্ষোভ আছে। এ সময় জামায়াতের একের পর এক নেতা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুললেও বিএনপি তাদের সঙ্গে মাঠে আন্দোলনে নামেনি।
জামায়াতকে ছাড়ার গুঞ্জন অনেক দিনের: এর মধ্যে বিএনপির জামায়াত ছাড়ার প্রসঙ্গ নানা সময়ই এসেছে। দশম সংসদ নির্বাচনের পর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোট কৌশলগত। সময় এলেই তিনি জামায়াতকে ত্যাগ করবেন।
এর মধ্যে ২০২১ সালের শুরুতে বিএনপি এই জোট ত্যাগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে আর গণমাধ্যমকে কিছু জানায়নি।
এখনই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিচ্ছে না কেউই: জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, এটা দলীয় বক্তব্য না। ব্যক্তি ও দলীয় বক্তব্য এক নয়। এ রকম যদি সিদ্ধান্ত হয় তাহলে দল থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হবে।
অপরদিকে জামায়াতের সঙ্গে জোট ছিন্নের বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা সময়মতো জানাব। এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না। ’
আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া: এমন পরিস্থিতিতে রোববার (২৮ আগস্ট) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, বিএনপির বড় উইকেট পড়ে গেছে। জামায়াত ইসলাম বলেছে বিএনপির সঙ্গে তারা আর নেই। বিএনপি নৈরাজ্য করে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। নৈরাজ্য করলে ছাত্রলীগ বসে থাকবে না।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৪ ঘণ্টা, ২৮ আগস্ট, ২০২২
এনবি/এমএমজেড