ঢাকা: নির্ধারিত সময়ে রিপোর্ট দিতে পারেনি কয়লানীতি রিভিউ কমিটি। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত রিভিউ কমিটিকে ৪ মাসের সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
রিভিউ কমিটির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন আরো ২ মাসের মতো সময় লাগতে পারে রিপোর্ট জমা দিতে। তবে কমিটির সদস্য পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর বাংলানিউজকে জানান, রিভিউ কমিটি বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।
এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের দাবি, দেশের জ্বালানি সংকট মোকাবেলা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কয়লার বিকল্প নেই। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও শেষ রক্ষা সম্ভব নয়।
বিদ্যুৎ সেক্টরকে স্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে কয়লার বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেছেন জ্বালানি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী ভুঁইয়া।
রিভিউ কমিটিকে সরকার দেশের কয়লা ক্ষেত্রের ভুগর্ভস্থ পানির স্তর, ভূ-তত্ত্ব গঠন ও ভূ-রসায়ন বিষয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে জোড় দিয়েছে। সেই সঙ্গে কয়লা তুলতে এলাকাবাসীর কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে তারও একটি তুলনামূলক চিত্র প্রতিবেদনে দিতে বলেছে।
সরকারের এই প্রত্যাশার বিপরীতে গঠিত রিভিউ কমিটি বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ি খনিতে পাইলট প্রকল্প নেওয়ার সুপারিশ দেওয়ার চিন্তা করছে বলে সুত্র জানিয়েছে। ’
রিভিউ কমিটি প্রধান পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছি। তবে বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর হওয়ায় আমরা সাবধানে এগিয়ে চলছি। আশা করছি শিগগিরই মতামত দিতে পারবো।
পাইলট প্রকল্প নেওয়ার জন্য সুপারিশ করার কথা আলোচনায় এসেছে। তবে তা চূড়ান্ত হয়নি বলেও জানান তিনি।
তিনি দাবি করেন, পানি উত্তোলন করলে কি পরিমাণ পরিবেশের ক্ষতি হবে এবং পানি রিইনজেক করা যাবে কিনা তা আমরা কেউ জানিনা। এখন যারাই যা বলছেন তা অনুমাণ নির্ভর। সে কারণে পাইলট প্রকল্প নেওয়া হলে বিষয়টি বিতর্কের উর্ধ্বে নেওয়া সম্ভব হবে।
কয়লা নীতি রিভিউ কমিটির সদস্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, আমি এই কমিটির কোনো মিটিংয়ে যাইনি। এ বিষয়ে কিছুই জানিনা।
ইজাজ হোসেন সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘সরকার আন্তরিক বলে আমার মনে হয় না। ’
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে কয়লার জন্য পৃথক নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। ২০০৫ সালে আইআইএফসি নামের দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে খসড়া কয়লানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আইআইএফসি প্রণীত খসড়া কয়লানীতি অনুমোদন না দিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে রিভিউ (সংশোধন সংযোজন) করার দায়িত্ব দেয় বিএনপি।
‘অধ্যাপক নুরুল ইসলাম খসড়া কয়লানীতির অনেকগুলো বিষয়ে পরিবর্তনের সুপারিশ করে রিপোর্ট জমা দেন। এরই মধ্যে বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা আসার ৬ মাসের মাথায় নতুন করে খসড়া কয়লানীতি প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেয়। বুয়েটের সাবেক ভিসি প্রফেসর আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।
পাটোয়ারী কমিটি নামে পরিচিত এই কমিটি খসড়া প্রণয়ন করে জমা দিলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হয়।
মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পাটোয়ারী কমিটির খসড়া কয়লানীতি অনুমোদন না করে জ্বালানি সচিবকে প্রধান করে রিভিউ করার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে।
আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি পাটোয়ারী কমিটির খসড়া যাচাই বাছাই শেষে, খসড়ার নীতি ও বাস্তবায়ন অংশকে দুই ভাগে ভাগ করে কিছু সংশোধনীসহ শুধুমাত্র নীতি অংশটি অনুমোদনের সুপারিশসহ গত বছরের অক্টোবর মাসে জমা দেয়।
আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ মোতাবেক চূড়ান্ত না করে চলতি বছরের মার্চ মাসে আবারও উচ্চ পর্যায়ের রিভিউ কমিটি গঠনের জন্য সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
প্রসঙ্গত, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে ৫টি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এরমধ্যে শুধুমাত্র বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। এছাড়া রংপুরের খালাশপীর, দিনাজপুরের ফুলবাড়ি, দীঘিপাড়া ও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে না। ’
উল্লেখিত ৫টি খনির মধ্যে জামালগঞ্জ কয়লা খনিটি ১৯৫৯ আবিষ্কৃত হয়। সেই সূত্র ধরে ১৯৬২ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব পাকিস্তানের অধীনস্থ ইউএন-পাক মিনারেল প্রকল্প জয়পুরহাটে জামালগঞ্জ কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কার করে।
এ যাবত আবিষ্কৃত কয়লাক্ষেত্র সমূহের মধ্যে এখানে সর্ববৃহৎ কয়লার মজুদ আশা করা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রটিতে আনুমানিক কয়লার মজুদ ধরা হয়েছে প্রায় ১০০০ মিলিয়ন টন। তবে দেশে আবিষ্কৃত কয়লা ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সর্বগভীরে (কুচমা ছাড়া) অবস্থিত।
এক সময়ে এখান থেকে কয়লা তোলা কঠিন মনে করা হতো। তবে বর্তমানে গ্যাসিফিকেশন প্রক্রিয়ায় এই কয়লা ক্ষেত্র থেকেও কয়লা আহরণ করা সম্ভব বলে দাবি করেছেন বাপেক্স সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক সামছুদ্দিন আহমেদ।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, ‘আমাদের দেশের কয়লা ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাসিফিকেশন (মাটির নিচে কয়লা গলিয়ে তরল) করে তুলে আনা গেলে ৪৫ টিসিএফ গ্যাস সমান জ্বালানি পাওয়া যাবে। এই বিশাল মজুদ ফেলে রেখে আমরা কয়েক মিলিয়ন গ্যাস আবিষ্কার হলে ফলাও করে প্রচার করি। ’
‘অপর ৪টির মধ্যে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক অধিদফতর খালাশপীর, দীঘিপাড়া ও বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি আবিষ্কার করে। আর ফুলবাড়ি কয়লাখনি আবিষ্কার করে অষ্ট্রেলীয়ান কোম্পানি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১২
ইএস
সম্পাদনা: আবু হাসান শাহীন, নিউজরুম এডিটর