ঢাকা: কাকরাইল থেকে আরামবাগ সড়ক। বুধবার সকালটাতে সেখানে ঝকঝকে রোদ।
সন্ধ্যার পরে এই সড়কটির দৃশ্য ভিন্ন। হলুদ আলো ছড়ানো ব্যয়বহুল সোডিয়াম বাল্বগুলো আর নেই। তার বদলে দ্যুতি ছড়ায় সৌরবিদ্যুতের মিষ্টি আলোর ছটা। ছুটে চলা গাড়ি আর চারপাশের শপিংমলগুলো থেকেও আলো আসে। ফলে রাতের রাস্তা পর্যাপ্ত আলোকিত। তাতে পথচারিদেরও নির্বিঘ্ন পথচলা। আর ছোট ছোট টং নিয়ে বসা ফুটপাত দোকানিদের ব্যবসাও চলে ভালো।
জুনের শেষ দিকে নগরীর এই সড়ক থেকে পুরোনো সোডিয়াম বাতি সরিয়ে নেয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। নতুন ল্যাম্পপোস্টে নতুন রূপে বসানো হয় নতুন আলোর বাতি। দিন ও রাত উভয় বেলায় দৃশ্যটি উন্নত কোনো শহরের দৃশ্য বলেই মনে হয়।
সরকারের একটি একটি পাইলট প্রকল্প। কাকরাইল থেকে আরামবাগ মোড় পর্যন্ত বসানো হয়েছে ৬১টি স্ট্রিট ল্যাম্পপোস্ট। প্রতিটি পোস্টের উপরে বসানো সাড়ে ৫ফিটের এক জোড়া সৌর প্যানেল। নগরীতে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্যানেলে যুক্ত বাতিগুলো জ্বলে ওঠে ভিন্ন এক আলোর পসরা নিয়ে।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। কাকরাইল থেকে আরামবাগ পর্যন্ত মোট ৬১ টি পিলারে ১২২টি বাতির এই প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২ কোটি টাকা। ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ পেয়ে এলাইড সোলার এনার্জি লিমিটেড একটি প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে।
কাকরাইলের ব্যবসায়ী মাহিদুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, “এতোদিন ধরে সোডিয়ামের হলুদ আলো দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। সৌর বিদ্যুতের নতুন এই আলো বেশ ভালোই লাগছে। আলো কিছুটা কম হলেও যতটুকু পাওয়া যায় তাই যথেষ্ট। কারণ এতে খরচ কম। প্রকৃতির দেওয়া দিনের আলোয় আলোকিত হচ্ছে রাতের ঢাকা এটিই গুরুত্বপূর্ণ।
মাহিদুল হাসানের এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত অনেকেই। সৌরবিদ্যুৎ কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুতের উপর চাপ কমানোর এই উদ্যোগের প্রতি সমর্থনও সবার। স্থানীয় অনেকেই বলেছেন, আমাদের দেশে অব্যাহত বিদ্যুৎঘাটতি মেটাতে সৌর বিদ্যুতের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভালো। একদিকে বিদ্যুতের ব্যবহার কমছে অন্যদিকে মৃদু এই আলোটাও বেশ চোখ-সহনীয় মনোরম। তবে আলোটা আরো বাড়াতে পারলে সবদিক থেকে পূর্ণতা পাবে। ”
আলো বাড়ানোর বিষয়টি অবশ্য প্রকৃতির খেয়ালের ওপরও কিছুটা নির্ভর করে। দিনভর বৃষ্টি ও মেঘে ঢাকা আকাশ প্যানেলগুলোতে আলো কম ধরা পড়ে। ফলে রাতে কিছুটা সমস্যা হয়। তারপরেও এ বিষয়টিতে বড় সমস্যা মনে করছে না স্থানীয়রা।
নতুন এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, “এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এ উদ্যোগে লোডশেডিংয়ের কোনো আশংকা নেই। পণ্যের গুণগত মান বজায় রেখে এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে সৌরবিদ্যুতের আলোয় নগরবাসী উপকৃতই হবে। ”
ফুটপাতের ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন খুবই খুশি। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “অনেক ভালো হইছে। আলো একটু কম থাকলেও সরকার বিদ্যুৎ বাঁচাইতে পারতাছে। সব রাস্তায় এমন লাইট দিয়া দেওন দরকার। তাইলে বাসা বাড়িতে কারেন্ট যাইবো না। ”
গোটা নগরীতেই এমন আলোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে মনে করেন অনেকে।
কেউ কেউ অবশ্য সৌরবিদ্যুতের এই আলোকে অপ্রতুল বলে মনে করেন। তারা বলেন, সোলার বাতি অবশ্যই ভালো। তবে এই বাতিগুলোর ক্যাপাসিটি ওয়াট আরো বাড়ানো উচিত। এতো স্বল্প আলোয় সহজে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক জাফর আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, “নগরীর চাইতেও এই উদ্যোগ মফস্বল এলাকায় বাস্তবায়ন করলে সুফল বেশি পাওয়া যাবে। নগরীতে সবসময় বেশি আলোর প্রয়োজন পড়ে। সোলার সেই আলো পূরণে যথেষ্ট নয়। কিন্তু মফস্বল এলাকায় অল্প আলোতেই অনেক কাজ করা সম্ভব। তাই সেখানকার সড়কগুলোতে এই প্যানেল স্থাপন করে তা থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ নগরে সংযোগ করলে অধিক সুফল পাওয়া যাবে। ”
তিনি আরো বলেন, “এই উদ্যোগের বাস্তবায়ন আরো ব্যাপক করা উচিত। রাস্তার চেয়েও নগরীর কমিউনিটি সেন্টার, হাসপাতাল, শিশু ও মাতৃসদন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয়গুলোতে সোলার প্যানেল স্থাপন করতে পারলে সহজে ভালো সাড়া পাওয়া যাবে। এর ফলে বিদ্যুতের ব্যবহার অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। ”
সড়ক বাতি সৌরবিদ্যুতের জ্বালানোর উদ্যোগকে সবাই স্বাগত জানালেও বাংলানিউজের অনুসন্ধানে অন্তরালের কিছু সমস্যাও বেরিয়ে আসে। কাকরাইল থেকে আরামবাগ পর্যন্ত যে সড়কে সৌরবিদ্যুতের বাতি লাগানো হয়েছে সেখানে আগে সোডিয়াম বাতি জ্বলতো। যেগুলো ছিল ১৫০ ওয়াটের। কিন্তু সৌর পদ্ধতিতে এখানে দেওয়া হয়েছে মাত্র ৬০ ওয়াটের বাতি। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই অপ্রতুল বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। আর এই বাতি জ্বালানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সাড়ে ৫ফিট দৈর্ঘ ও সাড়ে ৩ ফিট প্রস্থের সৌর প্যানেল।
সৌরবিদ্যুতের বাতি দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী আলো সরবরাহ করতে হলে এখানে ১০ থেকে ১৫ ফিটের সোলার প্যানেল বসাতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে মহানগরের সড়কের ওপর তা বসানো অনেকাংশেই অসম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
সৌর প্যানেল সূর্যের আলো ছাড়া বাতি জ্বালাতে পারে না। নগরের বড় বড় স্থাপনার কারণে সড়কে স্থাপিত সোলার প্যানেল দুপুরের পর আর সূর্যের আলো পায় না। ফলে এই বাতিগুলো মাঝ রাতে গিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।
তাছাড়া সোলার প্যানেল সহজে চুরি হয়ে যাওয়ার আশংকাও করছেন অনেকে। এর সঙ্গে যুক্ত ব্যাটারিও যে কোন সময়ে খোয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য অনেকের।
তবে এমন মন্তব্য উড়িয়ে দিয়েছেন ডিসিসি দক্ষিণের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক জাফর আহমেদ।
তিনি বলেন, “ব্যাটারি স্থাপন করতে মাটির অনেকটা নিচ পর্যন্ত গর্ত করে একটি বক্স তৈরি করা হয়েছে। সেই বক্সটির উপরে রয়েছে সিমেন্টের ঢালাই। ফলে এটা সহজে চুরি করা সম্ভব নয়। ”
``এমন একটি উদ্যোগকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই দেখতে হবে, তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে`` বলে মন্তব্য তার।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৯ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০১২
এমএ/সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটরjewel_mazhar@yahoo.com