ঢাকা: কুইক রেন্টাল পলিসি ঠিক ছিলো। কিন্তু এর প্রয়োগ সঠিকভাবে হয়নি।
এ মন্তব্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়ার।
সম্প্রতি মহাখালী ডিওএইচএস এর বাসভবনে (লেক ভিউ) বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে একথা বলেন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
এ সময় জ্বালানি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বিভিন্ন কর্ম তৎপরতা ও সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে ব্যক্তিগত মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরেন সুবিদ আলী ভুঁইয়া।
তার সঙ্গে বাংলানিউজের কথোপকথনের প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হলো আজ শনিবার।
সাক্ষাৎকারে `` দেশকে লোডশেডিং মুক্ত করার অঙ্গীকার সরকার পূরণ করতে পারবে না`` বলেও মত দেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া।
তিনি বলেন, “এদেশ কোনোদিনই লোডশেডিংমুক্ত হবে না। এখন জনসংখ্যার মাত্র ৫১ শতাংশ বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করছে। বাকি রয়েছে ৪৯ শতাংশ জনসংখ্যা। ৫১ শতাংশের বাড়ন্ত চাহিদাই মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। যাদের ঘরে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি তাদেরও বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার সংবিধান দিয়েছে। ”
সুবিদ বলেন, “বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে আরো ভালো ফল আশা করেছিলাম। ”
কুইক রেন্টাল না হলে আজ দেশের অবস্থা ভয়াবহ হতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সাময়িক সংকট মোকাবেলায় সরকার সফল হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে পারলে ভালো সুফল পাওয়া যেতো। তবে সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। ”
``দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টি জনগণ ভালোভাবে দেখছে না`` বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমি মনে করি বিষয়টি অন্যভাবেও মোকাবেলা করার সুযোগ রয়েছে। বিরোধীদল এ থেকে মুনাফা লুটতে পারে। ”
তিনি বলেন, “সব কথা বলা সম্ভব নয়। ইউরোপ হলে সম্ভব হতো। সত্য কথা বললেই এখানে বিরোধী ভাবা হয়। দেশের উন্নয়নে এ বিষয়টিও বড় অন্তরায়। ক্ষমতাবানদের চারপাশে কিছু চাটুকার থাকে, যারা প্রকৃত সত্য আড়াল করে রাখে। আর যারা বাস্তবতা তুলে ধরতে চায় তাদের নিন্দুক বলে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়। ”
তিনি মনে করেন, ``সিনিয়র নেতাদের দলের সমালোচনা করার অধিকার দেওয়া উচিত। তাদের দলেরও জন্যই মঙ্গল হবে। কারণ ছোট খাটো ভুলগুলো তারা শুধরে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। ``
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় কে চালায় তা নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে সুবিদ আলী ভূঁইয়ার।
তিনি মনে করেন, দেশের জ্বালানি খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এর কার্যক্রমের ধারবাহিকতার অভাব। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাবে দেশের এই খাত যতদূর যাওয়ার কথা ছিলো সেখানে যেতে পারেনি।
জ্বালানি খাতের প্রকৃত উন্নয়ন করতে হলে কয়লার বিকল্প নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এ উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতি ইউনিট ১৫ থেকে ২০ টাকা খরচ হয়। আর কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে খরচ হয় মাত্র ৪ টাকার মত। তাই সাশ্রয়ী উৎপাদনের জন্য কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো উচিত। ”
তিনি বলেন, “কয়লা উত্তোলন নিয়ে দেশে বিতর্ক রয়েছে, অনেকে কিছু না জেনেই এর বিরোধিতা করছেন। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে মত দিয়েছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে ৮০-৯০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন করা যায়। আর কূপ খনন পদ্ধতিতে খুব বেশি হলে ১৫-২০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন করা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও সংস্কৃত বিভাগ থেকে অনার্স পাস করে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন সেনাবাহিনীতে। আপনি প্রকৃত অর্থে বিশেষজ্ঞের মধ্যে পড়েন না, তাই আপনার মতামত গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন সমালোচকরা। - এ প্রসঙ্গের জবাবে তিনি বলেন, ``আমি আসলে এর উপযুক্ত না। তবে চোখের দেখাকে কি ভুল বলা যায়। ”
তিনি তার চীন সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পরে মাটি ভরাট করে আবার চাষাবাদ হচ্ছে। আবার বিশাল লেক তৈরি করা হয়েছে। যেখানে মাছ চাষ হচ্ছে। তাহলে আমাদের দেশে সমস্যা কোথায়?``
প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কয়লা রেখে দেওয়ার যে কথা বলেছেন সে বক্তব্যের সঙ্গেও কিছুটা দ্বিমত রয়েছে সুবিদ আলী ভূঁইয়ার। তিনি মনে করেন, ``কয়লা যত দ্রুত উত্তোলন করা যায় ততই দেশের জন্য মঙ্গল। ``
তিনি বলেন, “সরকার হয়ত ভাবছে এখন কয়লা উত্তোলন প্রক্রিয়া শুরু করলে এ সরকারের মেয়াদে কয়লা উত্তোলন সম্ভব নয়। তাই এ মুহুর্তে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। সরকার মনে করছে, আগামীতে ক্ষমতায় আসতে পারলে কয়লা উত্তোলন করবে। ”
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পুরোপুরি সফল দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা এ পর্যন্ত ৩৯ টি সভা করেছি। এ থেকে প্রায় ২শ’ সুপারিশ দিয়েছি। যার মধ্যে শতাধিক বাস্তবায়ন হয়েছে। ”
তিনি জানান, এ কমিটির ৬টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ গুলো হচ্ছে- বিগত সরকারের দুর্নীতি তদন্ত উপ-কমিটি, জ্বালানি আইন পরীক্ষা উপ-কমিটি, সিলেটে পাথর কোয়ারি সংক্রান্ত তদন্ত উপ-কমিটি, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মিটার রিডারদের দুর্নীতি তদন্ত উপ-কমিটি, নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ তদারক উপ-কমিটি ও দুর্নীতি তদন্ত উপ-কমিটি।
উপ-কমিটির তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ায় বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জেনারেল ম্যানেজারকে বরখাস্ত করতে বাধ্য করা হয়েছে। কর্ণফুলি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এমডির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এতে জ্বালানি খাতের দুর্নীতি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে বলেও মনে করেন তিনি।
এমপিদের সংসদীয় কমিটির সভাপতি করার বিধান করার বিষয়টিতে শেখ হাসিনা দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এতে মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহিতা অনেকে বেড়েছে। ”
তবে সুপারিশ বাস্তবায়ন অথবা এর অগ্রগতির বিষয়ে মাসে মাসে রিপোর্ট দেওয়া বাধ্যতামুলক করা গেলে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
সরকার জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় অনেক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “অফসোরে কনোকো-ফিলিপসকে কাজ দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হলে গ্যাস সংকট আর থাকবে না। ”
বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি নিয়ে সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, “কোন চুক্তিতেই দেশের স্বার্থহানি করা হয়নি। পত্র পত্রিকায় লেখালেখি হওয়ায় আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তারা আমাদের সব দেখিয়েছে। ”
সম্পাদিত চুক্তিগুলো প্রকাশ করার দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি গোপন রাখার রেওয়াজ সব দেশেই রয়েছে। এতে দোষের কিছু নেই। ”
সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত রায় বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, “খুব দ্রুত ব্লক নির্ধারণ করে কাজ শুরু করা প্রয়োজন। তা না হলে এ রায়ের অর্জন ব্যহত হতে পারে। ”
তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সভ্যতার মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়। কোন দেশের মাথাপিছু গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কত তা দিয়ে সেই জাতিকে মূল্যায়ন করা হয়। তাই ভালো কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া উচিত। ”
“স্বাধীনতার ৪০ বছরে যেখানে যাওয়ার কথা ছিলো আমরা সেখানে যেতে পারিনি” বলে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “এ জন্য আমরাই দায়ী। আমাদের অনৈক্যের সুযোগে অন্যরা সুবিধা নিয়েছে। ”
দেশের প্রকৃত উন্নয়নের জন্য সরকার ও বিরোধীদলকে একযোগে কাজ করার উচিত বলেও মনে করেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১২
এআর/ সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com