ঢাকা, শনিবার, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৭ সফর ১৪৪৭

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

মাফিয়া আমলার সাতকাহন-৩

বিদ্যুৎ খাতের নেপথ্যের লুটেরা

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩১, আগস্ট ২, ২০২৫
বিদ্যুৎ খাতের নেপথ্যের লুটেরা আহমদ কায়কাউস

আহমদ কায়কাউস বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ছিলেন দুই বছরের কম সময়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেই বিদ্যুতের সর্বোচ্চ লুণ্ঠন করেছেন তিনি।

বিদ্যুতের লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন করতে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই সরকার একের পর এক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আবুল কালাম আজাদকে। আবুল কালাম আজাদ বিদ্যুৎ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ‘কুইক রেন্টাল’ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। এজন্য আইন সংশোধন করা হয়। এর মাধ্যমে দুর্নীতির ফ্লাডগেট উন্মোচন করে দেন আবুল কালাম আজাদ।

বলা হয়, দ্রুত বিদ্যুৎসংকট মোকাবিলার জন্য ‘কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র’ স্থাপন করতে হবে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র যাঁরা স্থাপন করবেন, তাঁদের বিদ্যুৎ সরকার কিনুক না কিনুক তাঁদের ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ প্রদান করা হবে। এ ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান করা হবে ডলারে। আবুল কালাম আজাদ শুধু এ রকম একটি বিধিবদ্ধ আইনব্যবস্থাই করেননি, বরং এসব দুর্নীতি এবং লুণ্ঠন যেন আইন এবং বিচারের ঊর্ধ্বে থাকে, সেজন্য দায়মুক্তি আইন বা ইনডেমনিটি অ্যাক্ট করেছিলেন। বিদ্যুৎ খাতে যেসব কেনাকাটা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে সেগুলোর জন্য কোনো বিচার করা যাবে না। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে লুণ্ঠনের প্রবেশদ্বার উন্মোচিত হয়। সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা কুইক রেন্টালের জন্য আবেদন করতে থাকেন এবং হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেনের বিনিময়ে বিদ্যুতের কুইক সেন্টারের লাইসেন্স দেওয়া শুরু হয়। বিদ্যুৎ খাত হয়ে ওঠে হরিলুটের আখড়া। কিন্তু আবুল কালাম আজাদ এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কয়েকটি বিদ্যুৎ কুইক রেন্টালের অনুমোদন দেওয়ার পরই সেখান থেকে চলে যান। এরপর তিনি ইআরডি সচিব হয়েছিলেন। পরে তিনি আসেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব হওয়ার পরও তিনি বিদ্যুৎ বিভাগের ওপর নজরদারি রাখতেন। কারা কারা কুইক রেন্টাল পাবে, না পাবে ইত্যাদি তদারকি করবেন। কিন্তু আবুল কালাম আজাদের এ কর্তৃত্ব ভেঙে যায় যখন আহমদ কায়কাউস বিদ্যুৎ সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

বিদ্যুৎ সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেই আহমদ কায়কাউস নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর বিভিন্ন দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করেন। এর ফলে ২০১৬ সালে আহমদ কায়কাউস দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তত ৬৮টি বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা কুইক রেন্টালের লাইসেন্স আটকে যায়। এ ছাড়া যেসব কুইক রেন্টাল দেওয়া হয়েছে আহমদ কায়কাউস সেগুলোর ব্যাপারে তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। এদের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং কার্যকারিতা নিরীক্ষা করার জন্য পৃথক আরেকটি কমিটি গঠন করেন। এটি ছিল মূলত এসব কুইক রেন্টাল কোম্পানিকে বাগে আনা এবং তাদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ আদায়ের কৌশল। সে কৌশলে আহমদ কায়কাউস সফল হয়েছিলেন। বিদ্যুৎ খাতের কুইক রেন্টাল কোম্পানিগুলো বুঝতে পারে এখন ক্ষমতা কার কাছে। কাজেই তারা আবুল কালাম আজাদকে বাদ দিয়ে আহমদ কায়কাউসের দ্বারস্থ হতে শুরু করে। আহমদ কায়কাউস এদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়মিতভাবে আদায় করতে থাকেন। এ অর্থ দিয়ে তিনি মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আহমদ কায়কাউস বুঝতে পেরেছিলেন আবুল কালাম আজাদের কর্তৃত্ব যদি খর্ব না করা যায়, তাহলে বিদ্যুৎ খাতে লুণ্ঠন সম্ভব হবে না। আর এ কারণেই তিনি আবুল কালাম আজাদকে শেখ হাসিনার প্রভাববলয় থেকে দূরে ঠেলে দেন। আবুল কালাম আজাদের বিভিন্ন দুর্নীতি-অনিয়ম সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেন। এর ফলে শেখ হাসিনার সঙ্গে আবুল কালাম আজাদের দূরত্ব তৈরি হয়। আহমদ কায়কাউস একজন ধুরন্ধর মাফিয়া প্রকৃতির দুর্নীতিবাজ। তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে মিলেমিশে দুর্নীতি করার নীতিতেও বিশ্বাসী ছিলেন না। বিদ্যুৎ বিভাগে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একের পর এক কৌশল আঁটেন কায়কাউস। এর ফলে নসরুল হামিদ বিপুর কর্তৃত্ব বিদ্যুৎ বিভাগে কমে যায়। একসময় শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নসরুল হামিদ বিপুকে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দেবেন। কিন্তু সে রকম পরিস্থিতির মধ্যেও নসরুল হামিদ বিপু শেষ পর্যন্ত টিকে যান। সেটি ভিন্ন বিষয়। তবে আহমদ কায়কাউস ২০১৬ সালের শেষ সময় থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পর্যন্ত বিদ্যুতের একক অধিপতি হয়ে উঠেছিলেন। বিদ্যুৎ খাতে কী হবে, না হবে, কোথায় কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, কী কেনাকাটা হবে ইত্যাদি নির্ধারিত হতো আহমদ কায়কাউসের দ্বারা। দুর্নীতিবিরোধী প্রমাণ করে নিজেকে একজন সৎ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন বাকপটু এই আমলা। আহমদ কায়কাউসের সঙ্গে অন্য দুর্নীতিবাজদের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। অন্য দুর্নীতিবাজরা যেমন দেশে টাকা গ্রহণ করতেন, আহমদ কায়কাউস তেমনটি করতেন না। তিনি সব টাকা নিতেন বিদেশে। তিনি বিদ্যুৎ সচিব থাকাকালেই তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। ঢাকায় তিনি এক ধরনের ব্যাচেলর জীবনযাপন করতেন। তিনি তাঁর পরিবারকে দেখার জন্য কদিন পরপরই যুক্তরাষ্ট্রে যেতেন।

সরকারি নথি এবং প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২২-এ ছয় বছর আহমদ কায়কাউস যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন মোট ৫২ বার। অর্থাৎ প্রতি দুই মাসে তিনি অন্তত একবার যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। সবাইকে তিনি দেখাতে সক্ষম হন যে তাঁর পুত্র সেখানে থাকে, কন্যা সেখানে লেখাপড়া করে এজন্য তাঁর যাওয়াটা প্রয়োজন। কিন্তু মূল বিষয় ছিল তাঁর অর্থ পাচার করা। আহমদ কায়কাউস যে সময় যুক্তরাষ্ট্রে যেতেন, সে সময় কোনো না কোনো কুইক রেন্টাল কোম্পানি অথবা বিদেশি কোনো এজেন্ট তাঁর যুক্তরাষ্ট্র পৌঁছানোর আগে বা পরে যুক্তরাষ্ট্রে যেতেন। সেখানে তাদের আর্থিক লেনদেন ইত্যাদি হতো।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আহমদ কায়কাউস তাঁর স্ত্রী এবং কন্যার নামে অন্তত আটটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এগুলো সবই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ‘কে কে কনসালট্যান্ট’ বা ‘গ্রিন এনার্জি লিমিটেড’, ‘ক্লাইমেট অ্যান্ড পাওয়ার’ ইত্যাদি নামে নানা রকম কনসালট্যান্সি ও গবেষণা ফার্ম স্থাপন করা হয়েছে। সবকটিরই পেছনে আছেন আহমদ কায়কাউস এবং তাঁর পরিবার। মূলত এ ধরনের কনসালট্যান্সি ফার্মের মাধ্যমেই বাংলাদেশ থেকে পাচারের টাকা যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপদে সরিয়েছেন এবং সেখানে বিনিয়োগ করেছেন।

আহমদ কায়কাউসের দুর্নীতির প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন যতগুলো কুইক রেন্টাল দেওয়া হয়েছিল, প্রতিটি কুইক রেন্টাল কোম্পানি জানত মাসের নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত টাকা যুক্তরাষ্ট্রের নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দিতে হবে। এ টাকা না পৌঁছালে সেই কুইক রেন্টালের বিল আটকে দেওয়া হতো। শুধু কুইক রেন্টালের এ অর্থ নয়, জ্বালানি খাতে যত কেনাকাটা এবং টেন্ডার সেগুলোর ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন আহমদ কায়কাউস। আর এর মাধ্যমে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন আহমদ কায়কাউস। শুধু তাই নয়, ২০২৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আহমদ কায়কাউস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি সেলফ ডিক্লারেশন এফিডেভিট প্রদান করেন। এ ডিক্লারেশনের মাধ্যমে তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার বৈধ করে নিয়েছেন। সেলফ ডিসক্লোজাল এফিডেভিট হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি তাঁর অঘোষিত উপার্জনের অর্থ ‘অস্ত্র বা মাদক খাত থেকে উৎসারিত নয়’ মর্মে হলফনামা দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা দিয়ে অর্থ বৈধ করেন। যার ফলে আহমদ কায়কাউসের যুক্তরাষ্ট্রে যে সম্পদ এবং অর্থ রয়েছে সবই আইনের দৃষ্টিতে এখন বৈধ। সবকিছু তিনি করেছেন কৌশলে।

একটি কুইক রেন্টালের কর্ণধার জানিয়েছেন, তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্রে ড. আহমদ কায়কাউসের জন্য টাকা দিয়েছেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে মার্কিন আইন অনুযায়ী ট্যাক্সের টাকা আলাদাভাবে দিতে হয়েছে। ট্যাক্সের টাকা না দেওয়া হলে সে টাকা নিতেন না আহমদ কায়কাউস। ঘুষ লেনদেনে তাঁর শর্তই ছিল ট্যাক্সসহ টাকা দিতে হবে। ট্যাক্সের টাকা পরিশোধ করতে হবে। এখন যদি প্রতিটি কুইক রেন্টালের অডিট হিসাব নিরীক্ষা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁরা টাকা পাঠিয়েছেন। কোন কনসালট্যান্সি ফার্মে তাঁরা দিয়েছেন। প্রতিটি কনসালট্যান্সি ফার্ম আহমদ কায়কাউসের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। আর এভাবেই বিদ্যুৎ খাত ধ্বংস করেছেন তিনি। তবে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাতের সবচেয়ে বড় দুর্নীতিটি তিনি করেছেন গভীর সমুদ্রবন্দরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে। সে সময় তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব। প্রথমে যে কমিটি করা হয়েছিল, সে কমিটি আহমদ কায়কাউসের কথা শুনবে না জন্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। পরে আহমদ কায়কাউস পছন্দের কমিটি করেন। অবশ্য এ কাজ তিনি শেষ করতে পারেননি। দুর্নীতিতে মেধার প্রয়োগ ঘটিয়ে নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে একজন সত্যিকারের ‘হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই দুর্বৃত্ত মাফিয়া আমলা।

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।