ঢাকা: বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি বাতিল করলেও জামানত বাজেয়াপ্ত করতে চায় না বিদ্যুৎ বিভাগ। রাষ্ট্রের নয়, সামিট গ্রুপের স্বার্থই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কাছে।
তারা আসলে পরাজিত হতেই বেশি আগ্রহী। সে লক্ষ্যে ছক কষে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সরকারের প্রভাবশালী এক নেতার ভাইয়ের কোম্পানির বিরুদ্ধে গিয়ে বিরাগভাজন হতে চান না তারা।
সামিট গ্রুপের সঙ্গে বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে ২০১১ সালে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে প্রতি ইউনিট ২ দশমিক ৬৬ টাকা দরে বিদ্যুৎ কেনার কথা সরকারের। আর এ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর কথা ছিল ২০১৩ সালের আগস্টে। কিন্তু মেয়াদ গড়িয়ে গেলেও কাজ শুরু করতে ব্যর্থ হয় সামিট।
আইনানুযায়ী নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করতে ব্যর্থ হলে চুক্তি বাতিল ও তাদের জামানত ২৪ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু নজিরবিহীনভাবে দফায় দফায় সময় বাড়ানো হয়। তারপরও কাজ শুরু করতেই ব্যর্থ হয় কোম্পানিটি।
কঠোর সমালোচনার মুখে অবশেষে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সামিটের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয় বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু জামানত বাজেয়াপ্ত না করে সামিটকে ছাড় দিতে উঠে পড়ে লেগেছে একটি গ্রুপ।
উল্টো সামিটকে মামলা ঠুকে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে সামিট গ্রুপকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে, সরকারের পক্ষে দুর্বল তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হবে। যাতে সামিট গ্রুপ সহজেই মামলায় জয়ী হয়ে তাদের জামানত ২৪ কোটি টাকা ফেরত পেতে পারে।
এবি ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখা থেকে দেওয়া সামিট গ্রুপের ওই ব্যাংক ড্রাফটি ক্যাশ করার জন্য চিঠি দেওয়া হয় গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর। অন্যদিকে চিঠি দেওয়ার আগেই সামিট গ্রুপকে জানানো হয় মামলা ঠুকে দেওয়ার জন্য।
আর বিদ্যুৎ বিভাগের পরামর্শ মতো হাইকোর্টে একটি রিট দাখিল করে কোম্পানিটি। হাইকোর্ট জামানত বাজেয়াপ্ত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
পাওয়ার সেলের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানান, আমাদের এখান থেকেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে মামলা করার জন্য। কারণ আমাদের কর্তারা চান না সামিটের টাকা বাজেয়াপ্ত হোক।
তিনি আরও জানান, দুর্বল তথ্য, উপাত্ত ও যুক্তি তুলে ধরা হবে। যাতে করে সামিট গ্রুপের পক্ষে মামলার রায় যায়। যাতে সামিট ২৪ কোটি টাকা তুলে নিতে পারে।
পাওয়ার সেলের ডিজি মোহাম্মদ হোসেন সরাসরি বিষয়টি স্বীকার করেননি। তবে সামিটের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎ কেন্দ্র না হওয়ার পেছনে শুধু সামিটের দোষ নয়। বিদ্যুৎ বিভাগেরও কিছুটা ব্যর্থতা রয়েছে। কারণ আমরা যথাসময়ে জমি ও রাস্তার ব্যবস্থা করতে পারিনি। ’
সামিটের দায়েরকৃত ওই রিটের শুনানির তারিখ ধার্য ছিল ২৪ ডিসেম্বর। শীতকালীন ছুটির কারণে নির্ধারিত তারিখে শুনানি হয়নি। বিদ্যুৎ বিভাগ নিজে হারার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে বলেও দাবি করেছেন একাধিক কর্মকর্তা।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমতউল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সামিটকে এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আসলে সরকার কোনভাবেই সামিটের জামানত বাজেয়াপ্ত করতে চায় না।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুহু রুহুল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, সামিটের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। তারা রিট দায়ের করায় জামানতের বিষয়টি ঝুলে আছে। কোনভাবেই ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি আরও জানান, বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আর হচ্ছে না। এখন বিবিয়ানা উত্তর নামে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সেখানে হবে। যা পিডিবি নিজস্ব অর্থায়নে করতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চিঠি দিয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তাপস কুমার রায় বাংলানিউজকে জানান, টেন্ডার বাতিল করলে নতুন করে কাউকে দিতে হবে। সেটা সময়ের ব্যাপার, তাই সামিটকে কিছুটা সময় দেওয়া হয়েছিলো।
আগে বাতিল না করে শেষ মুহূর্তে এসে কেন বাতিল করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তাপস কুমার রায় বলেন, সামিট শুরু থেকেই বলে আসছে তারা অর্থায়ন যোগাড় করতে পারবে। তাই সময় দেওয়া হয়েছে। এতে দোষের কিছু নেই।
জনশ্রুতি রয়েছে, সামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পাচ্ছে মন্ত্রণালয়। এমন প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব বলেন, মন্ত্রণালয়ের কাউকে বিশেষ সুযোগ দেওয়া বা কাউকে চেপে ধরার সুযোগ নেই।
এদিকে, বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঝুলে রাখার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে ভয়ঙ্কর সব তথ্য। বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো যাতে যথাসময়ে না আসতে পারে তার জন্য সামিট গ্রুপসহ একটি সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করছে বিদ্যুৎ খাতে।
তারা কুইক রেন্টাল ব্যবসা জিইয়ে রাখতে এ পন্থা অবলম্বন করেছে। বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসলে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বন্ধ হয়ে যাবে। চক্রটি এরই মধ্যে সফলতা পেতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ৭টি রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এলে সামিটেরসহ অনেকের রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হবে। সে কারণে অতিমাত্রার মুনাফালোভী মানসিকতা থেকেই সামিট গ্রুপ এ অনৈতিক ব্যবসায় নেমেছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সামিট গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, অটবি, সিনহা গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপের বসে বসে টাকা আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। সে কারণে তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে এ কাজে নেমেছে। দেশের স্বার্থ তাদের কাছে বড় বিষয় নয়। এই চক্র দেশ বিকিয়ে হলেও টাকার পাহাড় গড়তে চায়।
বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ৪৫০ মেগাওয়াট। গ্যাসভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ২ দশমিক ৬৬ টাকা দরে সরবরাহ দেওয়ার কথা। কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ পেতে ভাড়াসহ প্রতি ইউনিট প্রায় ২০ টাকার মতো খরচ পড়ছে।
বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে এলে নতুন করে আর ৭টি কুইক রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তো না। এতে করে সরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করেও মুনাফা করতে পারতো। আর এখন সেখানে প্রতি ইউনিটে ঘাটতি যাচ্ছে প্রায় ১৫ টাকার মতো।
সে হিসেবে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে দৈনিক ১ কোটি ৮ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো। যে হিসেবে দৈনিক ১৬ কোটি ২০ লাখ টাকা (৪৫০*১০০০*২৪*১৫= ১৬২০০০০০০) সাশ্রয় হতো সরকারের। যা কুইক রেন্টাল সিন্ডিকেটের পকেটে চলে যাচ্ছে এখন।
এদিকে সামিটের বিবিয়ানা-১ এর সঙ্গে একই দিনে আরও ২টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ নির্মাণ চুক্তি করা হয় সামিটের সঙ্গে। এগুলো হচ্ছে বিবিয়ানা-১ ও মেঘনাঘাট ৩৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট। মেঘনাঘাটের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দর ধরা হয় ৩ দশমিক ১২ টাকা। মেঘনাঘাট এগিয়ে নেওয়ার পিছনেও সামিটের মুনাফালোভী মনোভাব কাজ করছে বলে জানা গেছে।
নতুন ও পুরনো মিলিয়ে সামিট গ্রুপ ৩১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এগুলো হচ্ছে, সাভার-৪৫ মেগাওয়াট, চান্দিনা-২৫ মেগাওয়াট, মাধবদী-৩৫ মেগাওয়াট, রূপগঞ্জ-৩৩ মেগাওয়াট, মাওনা-৩৩ মেগাওয়াট, জাঙ্গালিয়া-৩৩ মেগাওয়াট, মদনগঞ্জ- ১০২ মেগাওয়াট এবং উল্লাপাড়া-১১ মেগাওয়াট।
এর বাইরে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (কেপিসিএল) উৎপাদন ১০০ মেগাওয়াট থেকে বাড়িয়ে এখন ২৬৫ মেগাওয়াট করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ আজিজ খানের সেলফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৪
সম্পাদনা: হুসাইন আজাদ, নিউজরুম এডিটর