গাজীপুর: গাজীপুরের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচলিত আছে ‘বেড়ায় ক্ষেত খায়’, অর্থাৎ যে প্রাচীর ফসল রক্ষা করার কথা সে প্রাচীরই ফসল ধ্বংস করে। এই কথাটির বাস্তবতা বিপজ্জনকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে গাজীপুরের গ্যাস খাতে।
সরেজমিনে গাজীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, তিতাস গ্যাস অবৈধভাবে বিতরণের জন্য লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির অসাধু কর্মকর্তারা গোপনে লাইন স্থাপনের অনুমতি দিয়ে আবার লাইন বিচ্ছিন্ন করতে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে বেশ কয়েক দফায় গ্রাহকদের সঙ্গে গ্যাস সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। গ্যাস সংশ্লিষ। ট কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আক্রান্ত হয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এমনকি সংবাদ কর্মীরাও। এই অবস্থায়ই অবৈধ গ্যাস লাইন স্থাপন, নিয়ন্ত্রণ ও বিতরণ চলছে সমান তালে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুর জেলায় তিতাস গ্যাস চুরির কাজ করে প্রায় দুই ডজন কোটিপতির জন্ম হয়েছে। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার এই সুযোগটি এখন অবারিত হয়ে উঠছে। সূত্র বলছে, রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ার প্রয়োজন নেই। কোনো একটি অখ্যাত বা নামমাত্র পত্রিকার সাংবাদিকের পরিচয়পত্র নিয়ে গ্যাস অফিসে কোনো ঠিকাদারের পক্ষে গেলেই গ্যাস কর্মকর্তারা চুরি ধরা পড়ার কারণে নমনীয় হয়ে যান। ফলে সাংবাদিক নিয়ে যাওয়া ঠিকাদার অবৈধ লাইন বসানোর কাজ শুরু করেন।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কমপক্ষে ছয় হাজার ফুট বিতরণ লাইনের মাধ্যমে চোরাই পথে প্রায় শতাধিক বাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া যায়। প্রতিটি বাড়ি থেকে গড়ে এক লাখ টাকা করে নিলেও কোটি টাকার উপরে পকেটে চলে যায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের। অথচ, এই কাজ করতে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। ফলে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার জন্য গ্যাস চুরি একটি সহজলভ্য মাধ্যম হিসেবে পরিণত হয়েছে। এই কারণে গ্যাস চুরির ক্ষেত্রে চোরের সংখ্যাও বেড়ে গেছে।
অবৈধ গ্যাস লাইন পরিদর্শন করে দেখা যায়, অবৈধভাকে নিম্ন মানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি গ্যাস লাইন থেকে যে কোন মুহূর্তে বড় ধরণের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে যেতে পারে, যেটা বড় ধরনের ট্রাজেডিতে রূপ নিতে পারে।
সূত্র জানায়, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড আঞ্চলিক বিপণন ডিভিশন গাজীপুরের আওতায় দীর্ঘদিন যাবৎ চলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার উৎসব। কাঁচা টাকায় রাতারাতি বড় লোক হওয়ায় এই মহা আয়োজনে জড়িয়ে যাচ্ছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
পরিদর্শনে দেখা যায়, গাজীপুর জেলার সদর, কোনাবাড়ি, কাশিমপুর ও শ্রীপুর সহ প্রায় সকল জায়গায় চলছে অবৈধ গ্যাস সংযোগের কাজ। রাত-দিন চলছে মাটি খুঁড়ে লাইন বাসনোর কার্যক্রম। গ্যাস অফিসের এক শ্রেণীর অসাধু ঠিকাদার স্থানীয় দালালদের সঙ্গে মিশে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত দিচ্ছেন বাড়ি ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ড বাজার এলাকার গাছা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ২/৩ হাজার ফুট বিতরণ লাইন স্থাপন হচ্ছে। যারা লাইনের কাজ করছেন তারা জানালেন, জনৈক নাজমুল ইসলাম ও মাসুদ অবৈধভাবে এ কাজ করাচ্ছেন।
নাজমুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বাংলানিউজকে ধমকের সুরে বলেন, আপনারা যা করার করেন। আমরা অবৈধ লাইন স্থাপন করছি জনৈক সাংবাদিকের নির্দেশে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই নামের কোনো সাংবাদিক গাজীপুর প্রেসক্লাবে নেই।
প্রায় একই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে গাজীপুর শহরের বিলাশপুর এলাকার মুরগি ব্যবসায়ী রহম আলীর পক্ষ থেকে। অবৈধভাকে গ্যাস লাইন স্থাপন করে রাইজার পর্যন্ত বসিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে রহম আলী বলেন, আমি এমপি সাহেবের লোক। তবু লাইন বসানোর সময় কাপাসিয়ার এক সাংবাদিক এসে ৫ হাজার টাকা নিয়ে গেছে।
এ ছাড়া মহানগরের হাড়িনাল, ভূরুলিয়া, কোনাবাড়ি, কাশিমপুর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে দিনরাত চলছে গ্যাস চুরির হিড়িক।
বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোলেমান, ফারুক, জয়নাল, সোহাগ, রাজ্জাক, টুটুল, সোলেমান মুন্সি, কবির হোসেনসহ প্রায় অর্ধশত লোক চোরাই গ্যাস লাইন স্থাপনের কাজ করছেন।
সূত্র বলছে, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড গাজীপুর অফিসে মোট ৩৫ জন ঠিকাদার রয়েছেন। এসকল ঠিকাদার বিভিন্ন এলাকায় এজেন্ট নিয়োগ করে অবৈধ সংযোগের জন্য গ্রাহক ঠিক করেন। প্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে রাতারাতি সংযোগ দেন।
সম্প্রতি অবৈধ গ্যাস সংযোগের ব্যবসা করে অনেক ঠিকাদার ও এজেন্ট কোটিপতি হয়েছেন রাতারাতি। এদের সঙ্গে তিতাস গ্যাস অফিসের কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত।
সূত্র আরও জানায়, গাজীপুর জেলায় বর্তমানে গ্যাসের ৩৪ হাজার বৈধ গ্রাহক রয়েছেন। অবৈধ গ্রাহকের সঠিক সংখ্য্যা জানা না গেলে ঠিকাদারদের মতে সংখ্যাটি ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ২০ জুন আবেদন করা গ্রাহকদের বাসা-বাড়িতে গ্যাস সংযোগ থাকলে তা বৈধ করার কথা রয়েছে। কিন্তু যে সকল গ্রাহক আবদেন করেননি, তাদের বাসায় রাতারাতি গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে অবৈধভাবে। আবার দীর্ঘ দিন যাবৎ আবেদন করেও গ্যাস পাচ্ছেন না এমন গ্রাহকের সংখ্যাও অনেক।
সূত্র আরও জানায়, আবেদন করলেও যে সকল গ্রাহক বড় অংকের টাকা দিতে রাজি হননি তাদের বাসায় এখনো গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়নি।
এছাড়া, অবৈধ গ্যাস সংযোগের ছবি তুলতে গিয়ে হেনস্তা এমনকি শারীরিক আঘাতের শিকারও হচ্ছেন সাংবাদিকরা। আহতদের তালিকায় তিতাস গ্যাসের কর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, নিম্ন মানের জিনিসপত্র দিয়ে তড়িঘড়ি করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকায় পাইপ ফেটে বা ছিদ্র হয়ে গ্যাস বের হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে অবৈধভাবে নেওয়া সংযোগের ফলে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর এলাকায় একই পরিবারের ৪ জন গ্যাস বিস্ফোরণে নিহত হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের আঞ্চলিক বিপণন ডিভিশন গাজীপুরে কর্মরত জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) প্রকৌশলী মো. ওয়াহেদ জানান, তার অধীনস্থ চার জেলার মধ্যে গাজীপুরে কতোগুলো সংযোগ রয়েছে এ বিষয়ে তথ্য নিতে হলে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পিআরও’র মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। এমডি সাহেব অনুমতি দিলেই তথ্য দেওয়া যাবে।
গ্যাস সংযোগ পেতে কেমন খরচ অথবা একজন অশিক্ষিত গ্রাহক বিনা হয়রানিতে বাসা-বাড়িতে কীভাবে গ্যাস সংযোগ পাবেন এমন প্রশ্নের জবাবে জিএম মো. ওয়াহেদ বলেন, আমাদের ওয়েবসাইট দেখে জানতে হবে। গ্রাহক অশিক্ষিত হলে গ্যাস নেওয়ার বিষয়ে ঠিকাদারের পরামর্শ নিতে হবে। অফিসের কারো সঙ্গে কথা বলা যাবে না।
এছাড়া, একটি গ্যাস সংযোগ নিতে কতো টাকা লাগবে তার সঠিক কোনো অংক নেই বলেও জানান জিএম মো. ওয়াহেদ।
বাংলাদেশ সময়: ০১২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৪
সম্পাদনা: হুসাইন আজাদ, নিউজরুম এডিটর