ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

অটবি’র কোয়ান্টাম বিদ্যুৎ না দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে শত কোটি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৪
অটবি’র কোয়ান্টাম বিদ্যুৎ না দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে শত কোটি

ভেড়ামারা থেকে ফিরে: বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অটবি গ্রুপ। ভেড়ামারা ১১০ মেগাওয়াট কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামে এই টাকা তুলে নিচ্ছে বলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)সূত্র জানিয়েছে।


 
পিডিবি অনেক দিন ধরেই এই ভূয়া বিল আটকে রাখলেও এখন উচ্চ মহলের চাপে এই অর্থ প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এক্ষেত্রে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করছে এফবিসিসিআই এবং বিজিএমইএ’র একজন সাবেক সভাপতি। বাকপটু এই ব্যক্তিটি নাকি এখন অটবির কনসালট্যান্ট।

সংশ্লিষ্ট মহলে এ নিয়ে বেশ মুখরোচক আলোচনা রয়েছে যে, কোন রকম বিনিয়োগ ছাড়াই ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির শেয়ার দেওয়া হয়েছে তাকে। অটবির পক্ষে ওই টাকা ছাড় করতে একাধিক দিন বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে তদবির করতে দেখা গেছে তাকে।
 
ব্যাংক ঋণে জর্জরিত অটবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম পাওয়ার সিসটেম লিমিটেড ৩ বছর মেয়াদি ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করে। ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে এটির উৎপাদনে আসার কথা ছিলো। বিলম্বে আসার কারণে চুক্তি অনুযায়ী অটবিকে বিপুল অর্থ জরিমানা করা হয়।
 
আইপিপি সেল-১ এর পরিচালকও বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, কোয়ান্টাম পাওয়ারকে ৯১ লাখ ১৪ হাজার ৯৮৯ ডলার জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে আংশিক জরিমানা আদায় হয়েছে। আর মামলার কারণে অবশিষ্ট টাকা আদায় করা সম্ভব হয়নি।
 
অটবির সঙ্গে ১১০ মেগাওয়াট ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য চুক্তি সম্পাদন করে পিডিবি। আর প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য প্রতিমাসে ১৯ হাজার ২২০ ডলার ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।
 
কিন্তু অটবি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কোনদিনই নির্ধারিত ক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ১৪টি ইউনিটের মধ্যে প্রথম ইউনিটটি স্থাপনের সময়ই ভেঙে পড়ে। আর ১৪ নম্বর ইউনিটের বুস্টার ভেঙে গেলে সেটিও বিকল হয়ে রয়েছে ২ বছর ধরে।
 
নানা কারণে কোন দিনেই পূর্ণ ক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। পিডিবির ওয়েব সাইটেও বিষয়ে প্রদর্শিত রয়েছে। পিডিবির হিসেব মতে, অটবি গড়ে মাত্র ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। সে হিসেবে পিডিবি তাদের সর্বোচ্চ ১০ মেগাওয়াটের ভাড়া পরিশোধ করতে চায়।
 
পিডিবির আইপিপি সেল-১ (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট সেল) সূত্র জানিয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী অটবি ১০ মেগাওয়াটের ভাড়া পাওয়ার কথা। যাকে কুইক রেন্টালের ভাষায় ক্যাপাসিটি চার্জ বলা হয়। কিন্তু অটবি পুরো ১০৫ মেগাওয়াটের ভাড়া দাবি করেছে। যে কারণে এতোদিন বিষয়টি ঝুলে ছিলো।
 
কিন্তু বিগত সরকারের শেষ মুহুর্তে ওই মহলটির চাপে অটবিকে ছাড় দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অনেকটা জোর করেই আইপিপি সেল থেকে অর্থ ছাড়ে সম্মতি আদায় করা হয়।
 
খুব শিগগিরই অটবিকে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা দেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে জরিমানার টাকা আদায়ে ছাড় দেওয়া হচ্ছে বলে পিডিবির অর্থ পরিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে। আর পরিমাণ স্বীকার না করলেও আইপিপি সেলের পরিচালকও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
 
কোন আইনের কারণে এমনটি করা হচ্ছে জানতে চাইলে আইপিপি সেলের একজন কর্মকর্তা জানান, আসলে কোন আইন নয়। আগা গোড়া নষ্ট ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভাড়ার মেয়াদ আরও ৫ বছর বাড়ানো হচ্ছে। ওই চুক্তিতে একটি শর্ত রাখা হয়েছে। সেই শর্তের আওতায় ছাড় দেওয়া হচ্ছে।
 
শর্তে বলা হয়েছে, অটবি যেহেতু দ্বিতীয় মেয়াদে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনা করবে। তাই আপাতত তাদের জরিমানা কর্তন করা যাবে না। দ্বিতীয় মেয়াদে উৎপাদনে গেলে তখন জরিমানা আদায় করা হবে।
 
ওই কর্মকর্তা বলেন, আগের চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে চলার কথা। আর নতুন চুক্তি অনুযায়ী পরের মেয়াদে। কোন আইনেই পূর্বের মেয়াদে বিষয়টি নতুন চুক্তির আওতায় আসতে পারে না। আইনের লঙ্ঘন করে অটবিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
 
আইপিপি সেল-১ এর পরিচালক গোলাম কিবরিয়া জানান, অটবি যে পরিমাণ বিল দাবি করেছে তার প্রেক্ষিতে আপাতত আংশিক বিল দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের যেহেতু দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, তাই বর্ধিত মেয়াদের বিল পরিশোধের সময় জরিমানা কর্তন করা হবে।
 
কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বেশি বিল দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সব হচ্ছে। এখানে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না।
 
অটবির মালিকানাধীন ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির অপ‍ারেশন ইনচার্জ বাংলানিউজকে বলেন, নানা রকম হিসেব রয়েছে। এটা আপনারা বুঝবেন না।
 
তিনি বলেন, ২০১৩ সালের মার্চ থেকে আমাদের বিল আটকে রেখেছে পিডিবি। শুনেছি প্রায় ১৫০ কোটি টাকা সরকারের কাছে পাওনা রয়েছে আমাদের। বিল না পাওয়ায় মেশিন মেরামত করা যাচ্ছে না, লুব ওয়েল কেনা যাচ্ছে না। তাই পিডিবির ওয়েব সাইটে মেশিন এমসি প্রবলেম দেখাচ্ছে।
 
অটবির অতিলোভী মানসিকতার কারণে পুরাতন মেশিন আমদানি করে অটবি। আর এই পুরাতন মেশিনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের। তাদের দু’টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। যে কারণে দেউলিয়ার পথে রয়েছে কোম্পানিটি। শ্রমিক কর্মচারীদের বকেয়া না দিয়েই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
 
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এক দিনও ঠিকমতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি। যান্ত্রিক ত্রুটি লেগেই ছিলো। জেনে শুনে কেন এমন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আবার ভাড়া করছে সরকার তার কোনই যুক্তি খুজে পাচ্ছে না পিডিবি।
 
পিডিবি এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চুক্তির মেয়াদ না বাড়ানোর জন্য সুপারিশ দিয়েছিলো। কিন্তু তা কোনভাবেই ধোপে টেকেনি। বরং উল্টো চাপ দিয়ে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে।
 
বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব আনোয়ার হোসেনও ছিলেন সুপারিশকারীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বাংলানিউজকে জানান, কোয়ান্টামের ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কোনদিনই সঠিক মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে নি এ কথা সত্যি।
 
তাহলে কেন আবার ৫ বছরের জন্য ভাড়া করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার হোসেন বলেন, তারা বলেছে এবার পারবে। তাই দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।