ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

কুইক রেন্টাল সিন্ডিকেটের কাছে পরাজিত বিপিসি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৮ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৪
কুইক রেন্টাল সিন্ডিকেটের কাছে পরাজিত বিপিসি

ঢাকা: অবশেষে কুইক রেন্টাল সিন্ডিকেটের কাছে হেরে গেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সিন্ডিকেটকে তেল আমদানির ক্ষমতা দিতে আইন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।



১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী বেসরকারি কোন কোম্পানির জ্বালানি তেল আমদানির সুযোগ নেই। ওই অধ্যাদেশে জ্বালানি তেল আমদানি-রপ্তানি, বিপণন ও বিতরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন(বিপিসি) উপর ন্যস্ত করা হয়েছে।

বিপিসি প্রথম থেকেই এর বিরোধীতা করে আসছে। তারা তেল আমদানির নামে বিদেশে টাকা পাচার হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করে। কিন্তু ঠেকানো যায় নি। শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেট জয়ী হতে চলেছে।

বিপিসির অর্থ পাচারের শঙ্কা তখন উড়িয়ে দিলেও অল্প দিনের মাথায় ফলতে শুরু করেছে। এরইমধ্যে সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানি ও বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেডের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠান দু’টির আমদানিকৃত ফার্নেস অয়েলের তিনটি চালানে ১৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত পরিশোধের অভিযোগ উঠেছে।

সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানি তাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য গত ২৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে ১৮ হাজার ৪৬৬ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করে (এলসি নং-২৪৮৬১৩০২০৯৫৫)। প্রতিষ্ঠানটির বিল অফ লেডিংয়ে (বিএল) প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের দাম ধরা হয়েছে ৬৫৯ দশমিক ২২ মার্কিন ডলার।
 
এফওবি’র (ফ্রি অন বোড) ভিত্তিতে এম টি স্ট্রাভোলাস নামের একটি জাহাজে করে (ইনভয়েস নং-এসএপি/২০১৩/০৯/০০১, শিপমেন্ট তারিখ-২৯/০৯/১৩) এসব ফার্নেস অয়েল আমদানি করা হয়। এই আমদানি মূল্যের সাথে ২৫ ডলার প্রতি টন জাহাজ ভাড়া যোগ করলে দাম দাড়ায় ৬৮৪ দশমিক ২২ ডলার।
 
প্রায় কাছাকাছি সময়ে বিপিসি সিঙ্গাপুর থেকে সিএন্ডএফ (জাহাজ ভাড়াসহ) ভিত্তিতে ফার্নেস অয়েল আমদানি করেছে প্রতি টন ৬৫১ ডলার মূল্যে।
 
সামিট গ্রুপ ১০ জুন অপর একটি চালানে সিঙ্গাপুর থেকে আরও ১৯ হাজার ২৪৯ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করে (এলসি নং-২৪৮৬১৩০২১৩০৭)। এই চালানের বিল অফ লেডিংয়ে প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের দাম দেখানো হয়েছে ৬৫১ দশমিক ৯৫ ডলার। কিন্তু ওই সময় সিঙ্গাপুর ভিত্তিক তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে ফার্নেস অয়েলের দর ছিল প্রায় ৬১১ ডলার।
 
 প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের জন্য আর্ন্তজাতিক মূল্যের চেয়ে প্রায় ৪১ ডলার অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে। পুরো চালানটি পেছনে ৭ লাখ ৮৯ হাজার ২০৯ ডলার অর্থাৎ প্রায় ছয় কোটি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকা সিঙ্গাপুরের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে।
 
চট্টগ্রামের বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেড ৭ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুর থেকে পাঁচ হাজার ১২০ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করে (এলসি নং- ১০২২১৩০২০০০৯)। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের দাম দেখানো হয়েছে ৬২৪ মার্কিন ডলার। জাহাজ ভাড়া যোগ করা হয়েছে টন প্রতি ৮৮ ডলার।
 
ওই সময়ে(৩ ফেব্রুয়ারি)বিপিসি সিঙ্গাপুর থেকে (সিএন্ডএফ ভিত্তিতে অর্থাৎ জাহাজ ভাড়াসহ) ফার্নেস অয়েল আমদানি করেছে ৬১৩ ডলার মূল্যে।
 
প্রায় ১৭ দশমিক ছয় ডলার অতিরিক্ত দামে ফার্নেস অয়েল আমদানি করা হয়েছে। অর্থাৎ সিঙ্গাপুরের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৯০ হাজার ১১২ ডলার অর্থাৎ ৭০ লাখ ২৮ হাজার ৭৩৬ টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে।
 
প্রতিষ্ঠান দু’টি কিনতে ঠকেছে না কৌশলে টাকা পাচার করছে বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করছে বিপিসির কর্মকর্তারা।

২০১২ হঠাৎ তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে গেলে বাড়তি চাহিদা মেটাতে সংকটে পড়ে বিপিসি। ওই সময়ে সংকট কাটিয়ে উঠতে অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বিপিসির অনাপত্তি পত্র নিয়ে বেসরকারি কোম্পানিকে তেল আমদানি করার সুযোগ দেয়।
 
অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত ছিলো বিপিসি যদি অপারগ হয়। তাহলে তাদের অনাপত্তি নিয়ে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকরা বিদেশ থেকে তেল আমদানি করতে পারবে।

বিপিসি সূত্র জানিয়েছে,  ২০০৯-১০ অর্থ বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিলো ৩৭ লাখ টন। তেল ভিত্তিক কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কারণে ২০১১-১২ অর্থ বছরে এই চাহিদা ৮০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। যে কারণে হিমশিম খেতে হয়েছে বিপিসিকে। এখন বিপিসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে, বেড়েছে ধারণ ক্ষমতাও।

কুইক রেন্টাল সিন্ডিকেটের হাতে ক্ষমতা দিতে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে বলা হচ্ছে বেসরকারি কোম্পানির হাতে তেল আমদানির সুযোগ দিলে বিপিসির চেয়ে কম দামে পাওয়া যাবে। এতে লাভবান হবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)।

বিপিডিবি’র দাবি, বিদ্যুৎ উপাদনকারী কোম্পানিগুলো ফার্নেস অয়েল আমদানি করলে তাদের প্রতি লিটার মূল্য পড়ছে ৫৪.৭৮ টাকা। আর বিপিসিকে দিতে হচ্ছে ৬০.৯৫ টাকা।

বিপিসি দাবি করেছে, আপাতদৃষ্টিতে দাম বেশি দেখা গেলেও বিপিসির মাধ্যমে তেল আমদানিতে সরকার লাভবান হচ্ছে। কারণ বিপিসি প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের জন্য ৭ টাকা ডিউটি/ভ্যাট পাচ্ছে রাজস্ব বোর্ড। কিন্তু বেসরকারি কোম্পানির কাছে পাচ্ছে না।

অন্যদিকে বেসরকারি কোম্পানি তেল আমদানি করলে ৯ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিপিসিকে কোন রকম সার্ভিস চার্জ দেওয়া হয় না। ৫৫ টাকার ৯শতাংশ সার্ভিস চার্জ প্রায় ৫টাকা ও ভ্যাট ৭ টাকা যোগ হলে দাম পড়বে প্রায় সাড়ে ৬৭ টাকা।
 
বিপিসির চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, বিপিসি প্রতি লিটার তেল বাবদ ভ্যাট-ট্যাক্স দিচ্ছে ৭টাকার মতো। কিন্তু বেসরকারি কোম্পানিকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হচ্ছে না। সরকার যদি বিপিসিকেও অনুরূপ সুবিধা দেয় তাহলে তারাও প্রতি লিটারে কমপক্ষে ৭ টাকা কমে দিতে পারবে।

একপ্রশ্নের জবাবে বিপিসির চেয়ারম্যান বাংলানিউজকে জানান, বিপিসি এখন ফার্নেস অয়েল সরবরাহে সক্ষম। যা তিনি আন্ত:মন্ত্রণালয় সভায় জানিয়েছেন তারা সিদ্ধান্ত নিবে।

বিপিসির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সামিট গ্রুপসহ ৬টি কোম্পানিকে তেল আমদানির অনুমতিও দেওয়া হয়। নতুন করে আরও ৬টি কোম্পানি সাড়ে ৮ লাখ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানির আবেদন করেছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৪২ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।