ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বিদ্যুৎ নিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে সরকার

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১১
বিদ্যুৎ নিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে সরকার

ঢাকা: বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় রেন্টাল, কুইক রেন্টাল থেরাপি বিদ্যুৎ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। কারণ এক বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

আর এ খরচের বোঝার পুরোটাই গুনতে হচ্ছে জনগণকে।

দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ভর্তুকির বোঝা। তাই সরকারের সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
 
বিশেষজ্ঞদের দাবি, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে নতুন শিল্পায়ন না হওয়ায় স্থবির হয়ে আছে অর্থনীতি। বাড়ছে বেকারত্ব।

সংকট মোকাবেলায় গৃহীত দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প সমূহের অগ্রগতিও হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন তারা।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যে আইপিপি পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন চুক্তি বিদ্যুৎ খাতে জটিল সমীকরণে ফেলে দিচ্ছে। যা বিদ্যুৎ খাতকে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলেও মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, এক সময় বিদ্যুৎ না পাওয়াটা ছিলো সমস্যা। এখন বিদ্যুতের দামটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

মহাজোট সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তাতে বর্ধিত এই খাতকে ভর্তুকি দিয়ে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না বলেও মনে করছেন তারা।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সদস্য (বিতরণ) আব্দুহু রুহুল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ছিল ২ দশমিক ৬২ টাকা। এটা চলতি অর্থ বছরে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি অর্থাৎ ৪ দশমিক ১৫ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী অর্থবছরে এর দাম ৪ দশমিক ৮৬ টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে দাখিল করা বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে বিউবো বলেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৮ হাজার ৬২৬ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে তাদের ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার ২২৭ মিলিয়ন টাকা (প্রতি ইউনিট ৪ দশমিক ৩১ টাকা)।

প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় গড়ে ৪ টাকা ৩১ পয়সা পড়লেও তারা ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে (ডিপিডিসি) দেয় ২ টাকা ৭৮ পয়সা দরে।

ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে (ওজোপাডিকো) ২ টাকা ৪৭ পয়সা দরে, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে (আরইবি) ২ টাকা ৪৭ পয়সা দরে এবং বিউবোর নিজস্ব জোনে ২ টাকা ৬৭ পয়সা দরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে।

এভাবে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রির কারণে শুধুমাত্র ২০১০-১১ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিউবোর এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, বর্তমান পরিস্থিতিকে তবু সহনীয় বলা চলে। কিন্তু সম্প্রতি যেসব আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট) চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে, এসব কেন্দ্র আগামী ৬ মাস পর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করবে। এগুলো থেকে সরকারকে সর্বনিম্ন ৭ টাকা থেকে সোয়া আট টাকা (প্রতি ইউনিট) দরে বিদ্যুৎ কিনতে হবে।

এছাড়া এইচএফও (হাইড্রো ফার্নেস অয়েল) ভিত্তিক পিকিং পাওয়ার প্লান্টগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিট প্রতি প্রায় ৭ টাকার বেশি খরচ পড়বে।

তিনি আরও জানান, বিদ্যুৎ বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উদ্বিগ্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে। কারণ উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে উৎপাদন খরচ।

মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দ্রুত গতিতে বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলা সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে সাফল্য হতাশাজনক।

তিনি বলেন, খুলনার ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলোর কোনওটাই নির্ধারিত পরিকল্পনা মোতাবেক এগুতে পারেনি।

তবে বিদ্যুৎ খাতের জন্য এখন পর্যন্ত আশার একমাত্র খবরটি হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু এখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য কমপক্ষে ৭ বছর অপেক্ষা করতে হবে সরকারকে।

কনজুমারস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বাংলানিউজকে জানান, অপরিকল্পিতভাবে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করায় দেশকে চরম ঝুঁকিতে ফেলে দিবে।

তিনি বলেন, ‘সরকার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু যেভাবে উৎপাদন ব্যয় বাড়াচ্ছে। সেই তালে দাম বাড়াতে পারবে না। ’

বিদ্যুতের দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন।

তিনি বলেন, সরকার বর্তমানে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু একবার দাম বাড়িয়েই রক্ষা পাবে না। কারণ ভর্তুকি নিয়ে সরকারের যখন লেজে গোবরে দশা, ঠিক একই সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমানো নিয়েও সরকারকে ভাবতে হচ্ছে। ’

তবে পিডিবির চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবির বাংলানিউজকে বলেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বহুমুখি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট উৎপাদনে এলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

এছাড়া পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সংস্কার করে উৎপাদন বাড়ানোর কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী ভূঁইয়া বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।