ঢাকা: মাগুরার আলোচিত সেই ৮ বছরের শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। রায়ে মামলার প্রধান আসামি শিশুটির বোনের শ্বশুর হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
শনিবার (১৭ মে) সকালে মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের দেওয়া এই রায়ে সন্তুষ্ট নন ভুক্তভোগী শিশুটির পরিবার। রায় ঘোষণার পর আদালত চত্বরে ক্ষোভও প্রকাশ করেন তারা।
দ্রুত সময়ে হওয়া আদালতের এই রায়ে ভুক্তভোগী শিশুটির বোনের স্বামী সজীব শেখ (১৯) খালাস পেলেও স্ত্রীকে আর তার কাছে পাঠাবে না পরিবার। বরং নতুন জীবন শুরু করতে শিশুটির বোনকে পুনরায় স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। নিয়মিত পড়ালেখাও করছে সে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় সজীব শেখের সঙ্গে বিয়ে হয় শিশুটির বোনের। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ায় আর পড়াশোনা হয়নি তার। কিন্তু নিজের শ্বশুর বাড়িতে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ছোট বোনের মৃত্যুর পর ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসে সে। তারপর বেশ কয়েক দিন মানসিক যন্ত্রণায় ঘরবন্দি থাকার পর পুনরায় নবম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়েছে তাকে।
শনিবার রায়ের পর ভুক্তভোগী শিশুটির মা আয়েশা আক্তার বলেন, আমার বড় মেয়ের সংসারে যে বর্বর পৈশাচিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তারপর আর আমি ওই পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন করতে চাই না। আমার মেয়ে আর ওই পরিবারে
ফিরে যাবে না। সজীবের সঙ্গে আর সংসারও করবে না। সে লেখাপড়া করছে। মানুষের মতো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছে। আপনারা তার জন্য দোয়া করবেন।
রায়ে সন্তুষ্ট নয় পরিবার, আতঙ্কে কাটছে দিন
এদিকে আলোচিত এই ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায়ে সন্তুষ্ট নয় ভুক্তভোগী শিশুটির পরিবার। তাদের দাবি, তারা ন্যায় বিচার পাননি। ভুক্তভোগী শিশুটির স্বজনরা দাবি করেন, হিটু শেখকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলেও, বাকি আসামিরা ধর্ষণ ও হত্যায় সহায়তা করেছে— তাদের খালাসে ন্যায়বিচার হয়নি।
শিশুটির মা আয়েশা আক্তার বলেন, এই মামলায় আলামত নষ্ট ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত চার আসামির শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। তদন্তে গাফিলতির কারণে একজনকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, যা যথাযথ ন্যায়বিচার নয়। আদালতের পর্যবেক্ষণে বিষয়গুলো আরও স্পষ্টভাবে উঠে আসা প্রয়োজন ছিল।
আদালতের রায়ে বাকি তিন আসামি খালাস পেয়ে যাওয়ায় আতঙ্কেও রয়েছে পরিবারটি। আয়েশা আক্তার বলেন, তিন সন্তান নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। হিটু শেখের শাস্তি হলেও তার দুই ছেলে সজীব ও রাতুলকে খালাস দেওয়া হয়েছে। তারা ছাড়া পেলে ভয় ভীতি দেখানো ও আমাদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আজকে আদালতে ঘোষণার সময় তারা দুইজনকে (সজীব ও রাতুল) হাস্যোজ্জ্বল দেখা গেছে। তারা অনুশোচনায় ভুগছেন না। বরং কারাগার যেহেতু খালাসের আদেশ দিয়েছে, তারা মুক্তি পাওয়ার পরে নতুন করে হামলা করতে পারে।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলা নিয়ে মানুষের মধ্যে যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ ছিল রায়ের পর তা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। অনেকে বিভিন্ন মন্তব্য করলেও তাদের মধ্যে সন্তুষ্টি দেখা গেছে।
মাগুরা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহেদ হাসান টগর বলেন, এই বিচারের মধ্য দিয়ে স্বল্প সময়ে যে রায় হয়েছে, তা মাগুরাবাসীর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। সারা দেশের বিচার প্রার্থীদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে।
রায়ে সন্তুষ্ট নয় দণ্ডপ্রাপ্তের পরিবারও
আদালতের রায় ঘোষণার পর দণ্ডপ্রাপ্ত হিটু শেখের মেয়ে নাসরিন আক্তার বলেন, আমরা গরিব মানুষ, ভালো আইনজীবী নিতে পারিনি। সরকারিভাবে যে আইনজীবী দেওয়া হয়েছিল, তিনিও আমাদের পক্ষে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেননি। আমার বাবা, মা ও ভাইদের অন্যায়ভাবে মামলায় আসামি করা হয়েছে। আমরা নিরপেক্ষ তদন্ত চাই।
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এহসানুল হক সামাজী বলেন, মামলার সকল কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে এবং প্রমাণাদি যাচাই-বাছাই করেই আদালত রায় দিয়েছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে হিটু শেখের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। এই রায় একটি দৃষ্টান্ত, যেন ভবিষ্যতে আর কোনো শিশু বা নারী এমন পাশবিক নির্যাতনের শিকার না হয়।
উল্লেখ্য, গত ৫ মার্চ মাগুরার নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয় ৮ বছরের শিশু আছিয়া। পরদিন ৬ মার্চ তাকে অচেতন অবস্থায় প্রথমে স্থানীয় একটি মাদরাসার ইমামের কাছে নিয়ে যান হিটু শেখের স্ত্রী জাহেদা বেগম। পরে তাকে সেখান থেকে মাগুরা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেখান তার অবস্থার অবনতি ঘটলে ওইদিনই প্রথমে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ও পরে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৩ মার্চ মারা যায় পাশবিক নির্যাতনের শিকার শিশুটি। সেদিনই তার মরদেহ সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে মাগুরা এনে নিজ গ্রামে দাফন করা হয়। এই ঘটনায় ৮ মার্চ মাগুরা সদর থানায় মামলা করেন শিশুটির মা আয়েশা আক্তার। মামলায় আসামি করা হয় শিশুটির বোনের স্বামী সজীব শেখ, ভাশুর রাতুল শেখ, শ্বশুর হিটু শেখ ও শাশুড়ি জাহেদা বেগমকে।
গত ১৩ এপ্রিল আলোচিত মামলায় অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৩ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় বিচার কার্যক্রম। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ২৭ এপ্রিল। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন ২৯ জন। গত ৭ মে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ১৩ মে মামলার শেষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ শনিবার (১৮ মে) রায় ঘোষণা করে বিচারক। ঘটনার মাত্র দুই মাস ১১ দিনের মাথায় এই মামলার রায় দেওয়া হয়।
এসসি/এসএএইচ