ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্পেন

বাংলার আলোয় আলোকিত পাতায়া

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১৫
বাংলার আলোয় আলোকিত পাতায়া ছবি: বাংলানিউজেটোয়েন্টিফোর.কম

পাতায়া (থাইল্যান্ড) থেকে: রাত সাড়ে ১১টা। থাইল্যান্ডের আলো ঝলমলে বিনোদন নগরী পাতায়ার সেকেন্ড রোডে তখনো ঝাঁপি নামেনি একটি দোকানের।

সেই দোকানটির এক নারী ভিনদেশি কর্মীদের সঙ্গে ব্যস্ত দিনের হিসাব মেলাতে। এই নারীর নাম ‘আলো’। পুরো নাম কানিজ ফাতেমা তালুকদার। নরসিংদীর এই মেয়েই এখন আলো ছড়িয়ে আলোকিত করেছেন পাতায়াকে।

কীভাবে? তার গুণ আর ব্যবহারে সাড়া পড়ে গেছে ভিনদেশিদের মাঝে। একজনের মাধ্যমে আরেকজন। প্রতিদিন এভাবে আলোর কাছে দীর্ঘ হচ্ছে দেশ-বিদেশের নানা মানুষের নামের তালিকা। হাল ফ্যাশনের শার্ট, প্যান্ট, স্যুট তৈরির জন্যেই তারা ছুটে আসেন আলোর এই প্রতিষ্ঠানে।

প্রতিষ্ঠানটির নাম নেক্সট ফ্যাশন। এক কথায় দর্জিবাড়ি। যেখানে রয়েছে বিশ্বের নামকরা নানা ব্র্যান্ডের কাপড়ের সমাহার। গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে শার্ট, প্যান্ট আর স্যুট তৈরির জন্য পাতায়ায় রয়েছে নিজের তিনটি কারখানা। যেখানে কাজ করছে বাংলাদেশসহ থাইল্যান্ড, ভারতের অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ।

এই আলোই ব্যবসা সামলে আবার পুরোদস্তুর সংসারী। স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার। মা হিসেবে ছেলে-মেয়েদের উন্নত পড়াশোনার জন্যও নানা ব্যস্ততার মাঝে দৌড়ঝাপ করতে হয় নানা জায়গায়।

নরসিংদীর সাটির পাড়া গ্রামের আব্দুর রউফ মিয়ার মেয়ে কানিজ ফাতেমা আলোর সঙ্গে বিয়ে হয় বরিশালের দীন মোহাম্মদ তালুকদারের। সময়টা ছিলো ১৯৯৮ সাল। দীন মোহাম্মদ তালুকদার তখন প্রবাসী (থাইল্যান্ড)। বড় ভাই মাহবুব আলম তালুকদের মাধ্যমে প্রবাসে এসে চেষ্টা করছেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। পারিবারিক পছন্দে বিয়ের তিন মাস পর আলোও চলে আসেন থাইল্যান্ডের পাতায়ায়। স্বামীর হাত ধরেই সাফল্যের শিখরে নিয়ে আসেন এই ব্যবসাকে।

এই সাফল্যের ঢেউ পাতায়ার সমুদ্র সৈকত থেকে পৌঁছে গেছে বঙ্গোপসাগরের সৈকতে। কেবল প্রবাসেই নয়, দেশেও আলোর মর্যাদা ভিন্ন উচ্চতায়। সেখানে তার মাধ্যমে আরও উন্নত হয়েছে পরিবারের সদস্যরা। সন্তানদের দেশজ সংস্কৃতিতে লেখাপড়ার জন্য তাদের দেশেই রেখেছেন মায়ের কাছে। নিয়মিত দেশে ছুটে গেছেন সন্তানদের কাছে। খোঁজ খবর নিয়েছেন তাদের লেখাপড়ার। দেশের পাঠ চুকিয়ে ছেলে আরছি তালুকদারকে উচ্চতর শিক্ষার জন্যে পড়তে পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। স্বামীকে নিয়ে নিজে প্রবাসে থাকলেও মন পড়েই থাকে ছোট্ট মেয়ে আজনি তালুকদার আসকার কাছে। আসকা পড়ছে রাজধানীর বারিধারায় স্কলাস্টিকা স্কুলে। কেজি টু’র শিক্ষার্থী আসকার ভবিষ্যৎ গড়াই তার লক্ষ্য। যে কারণে হরহামেশাই আলোকে ছুটতে হয় ঢাকায়। আবার ব্যবসার জন্যে থাকতে হয় থাইল্যান্ডের পাতায়ায়। সেখানেও সামলাতে হয় ঘর সংসারের যাবতীয় কাজ।

এভাবেই একজন আলো, একজন নারী হয়ে উঠেছেন প্রবাসে সাফল্যের প্রতীক। স্বদেশিদের কাছে অনুকরণের শ্রদ্ধার প্রিয় ভাবী।

তবে আলোর এই সাফল্য একদিনে আসেনি। স্বামীকে নিয়ে থাইল্যান্ডের কসামুই দ্বীপে তিনি গড়ে তুলেছিলেন টেইলারিং শপ। নাম দিয়েছিলেন দীন ফ্যাশন। সেখানে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পেয়ে চলে আসেন সৈকত নগরী পাতায়ায়। এখানে পরিশ্রম, মেধা আর একাগ্রতা আর পেছনে ফিরে তাকাতে দেয়নি আলোকে।

এই দম্পতি জুটিই এখন পাতায়ায় প্রবাসীদের অনেকের কাছে জীবন সংগ্রামে সাফল্যের প্রতীক।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে কানিজ ফাতেমা তালুকদার আলো বলেন, ‘ফ্যাশন নিয়ে নিজেকে বেশ সচেতন থাকতে হয়। ইউরোপ-আমেরিকা থেকেই অধিকাংশ মানুষ এখানে আসেন বেড়াতে। তাদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টই মাথায় রাখতে হয়। ’

আলো জানান, এক’শ ডলার থেকে তিন হাজার ডলারের স্যুটের অর্ডার পান তারা। কাপড় আর সেলাই- দুটি মিলিয়েই লাভ থাকে প্রায় অর্ধেক। বিদেশি পর্যটকরা সকালে অর্ডার করলেই বিকেলে হাতে পেয়ে যান স্যুট। দামও ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অনেক কম। যার কারণে বেড়াতে এসেও তারা আগ্রহী হন হাল ফ্যাশনের শার্ট, প্যান্ট আর স্যুটে।

আলো বলেন, ‘হ্যান্ড মেইড হিসেবে আমরা সেরাটা দিতে চেষ্টা করি আমাদের গ্রাহকদের। যার কারণে একজনের মাধ্যমেই অন্যরা চলে আসেন এখানে। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় ব্যবসার বিশাল এক নেটওয়ার্কের। ’

দোকানে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি সারি করে রাখা বিশ্বের নামী দামী ব্র্যান্ডের ফেব্রিকস। এর মাঝেই হাতে তৈরি নানা ধরনের শার্ট, প্যান্ট আর স্যুট।

ব্যবসা সামলে সংসার, আবার দেশে সন্তানদের লেখাপড়ার খোঁজ খবর। একজন মানুষের পক্ষে কীভাবে সম্ভব? আলোর সহাস্য উত্তর, ‘সম্ভব বলেই তো আমরা পেরেছি। এই চেষ্টার কারণেই মানুষ আজ আমাকে চেনে। বাংলাদেশকে চেনে। এটাই মনে হয় আমার সর্বোচ্চ সাফল্যে। বিদেশি পর্যটকদের অনেকেই আমার কাছ থেকে বাংলাদেশের নাম জেনে সেই দেশটি সম্পর্কে আগ্রহভরে জানতে চায়। বলতে পারেন এটাই প্রাপ্তি।

আলোর এই সাফল্যে অবিরত প্রেরণা যুগিয়ে যান স্বামী দীন মোহাম্মদ তালুকদার। তিনি বাংলানিউজকে গর্বের সঙ্গে বলছিলেন, ‘আসলে ব্যবসা-সংসার সবই দেখে ও। বাসা-দোকান ভাড়া,ইলেকট্রিসিটি বিল, এখানে দু‘টো গাড়ির কাগড়পত্র, ব্যাংকের লেনদেন, সবই ও করে। আবার দেশে বারিধারায় যে বাড়ি, তার দেখভালও করতে হয় ওকে। ওর কারণেই আমি অনেক নির্ভার। যার কারণে স্বদেশি কেউ এলে তাদের সময়ও দিতে পারি বেশি।

স্বামী দীন মোহাম্মদ তালুকদারের মতো অন্য প্রবাসী বাংলাদেশিরাও মনে করেন, এমনভাবে সব সামলে সাফল্যের পথে ছুটে চলেই বাংলার ‘আলো’ আলোকিত করে চলেছেন আলো ঝলমলে পাতায়াকে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১৫
এইচএ

** সিন্ডি হতে পারে তৃতীয় লিঙ্গের মডেল
** পাতায়ায় দেশি খাবারের স্বাদ
** ‘আমিও হাঁপাচ্ছি’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

স্পেন এর সর্বশেষ