ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্পেন

থাইল্যান্ডের আজিজুল

দেশে ফিরতে না পারা মানুষটিই কমিউনিটির স্বজন!

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৫
দেশে ফিরতে না পারা মানুষটিই কমিউনিটির স্বজন! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ব্যাঙ্কক (থাইল্যান্ড) থেকে: ঢাকার সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলেন থাইল্যান্ড। টাকা ফুরিয়ে যাওয়ায় দেশে ফিরতে পারেননি তিনি।

সেই তিনিই এখন অনেকেরই আশ্রয়।

তার ঠাঁই পেয়ে দূর প্রবাসে এখন অনেকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। প্রবাসীদের কাছে আস্থা, বিশ্বাস আর নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন তিনি। নিজের চেষ্টা, পরিশ্রম আর সততায় থাইল্যান্ডে আজ প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আজিজুল হক।

থাইল্যান্ডে বাঙালি কমিউনিটির কাছে তার পরিচয় প্রিয় আজিজ ভাই। বাংলাদেশি কমিউনিটির বিপদ-আপদ, সন্তানদের বিয়ে-শাদী, বিচার-সালিশ, দেশ থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের সংবর্ধনা সব কিছুতেই ডাক পড়ে তার। মানুষের জন্য কিছু একটা করতে পারার আনন্দ তার ভেতরেও খেলে যায়।

শূন্য থেকে শীর্ষে আসার বিষয়টি অনেকটা রূপ কথার গল্পের মতোই। আর এ পর্যায়ে পৌঁছাতে তাকে দিনের পর দিন অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে শুরু করে আজ নিজেকে পরিণত করেছেন অন্যতম রফতানিকারক হিসেবে।

১৯৭৮ সাল। নারায়ণগঞ্জের ধনী বাবার একমাত্র সন্তান ওমর তার বন্ধু। দুজনে এক সঙ্গে পড়তেন সিটি কলেজে। পরীক্ষা শেষ। সেই বন্ধুকে নিয়েই অ্যাডভেঞ্চারে প্রিয় তিন বন্ধু এক সঙ্গে ঘুরতে গেলেন থাইল্যান্ড। চারদিনের মাথায় খেয়াল হলো, হাতে অবশিষ্ট অর্থ বলতে যা আছে, তা দিয়ে বড় জোর একজনের ফেরা হবে।

চারদিক তখন অন্ধকার। ঠিক হলো, ওমরকেই দেশে পাঠানোর। ধনী বাবার কাছ থেকে টাকা-পয়সা এনে দুই বন্ধুকে দেশে ফিরিয়ে নেবে সে।

কিন্তু সেই যে ওমর গেল, আর ফিরে এলো না। দেশেই তাকে আটকে ফেললো বাবা। তখন বন্ধু তোতলা বাবুলকে নিয়ে ঘুরতে থাকলেন ব্যাঙ্ককের পথে পথে। ইতোমধ্যে, ভিসার মেয়াদও ফুরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। এক সময় সিদ্ধান্ত নিলেন, সীমান্ত পেরিয়ে মালয়েশিয়া যাবেন। বাংলাদেশি মানেই তখন প্রবাসীদের কাছে অনেক সম্মানের। সবাই তখন খুব সমীহ করতো। ‘ইউ আর বাংলাদেশি, ইউ আর স্টুডেন্ট’ বলে সস্নেহে অনেকে খাওয়াতেন কিংবা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পৌঁছেও দিতেন।

এভাবে এন্ট্রি ভিসা নিয়ে চলে গেলেন মালয়েশিয়ায়। সীমান্ত থেকে ২৫ কিমি দূরত্বে কোতাবারু নামের এক জায়গায়। হাতে তখন সাকুল্যে মাত্র ৪শ বাত। চুঙ্গাইগোলক থেকে ব্যাঙ্ককের ট্রেন ধরতে যাওয়ার পথে দেখেন, ট্রেন চলে গেছে। বিপদে পড়লেন তিনি।

এখানেই পরিচয় হলো আরাকানি বংশোদ্ভূত চাটগাঁওয়ের এক বাসিন্দার সঙ্গে। বাংলাদেশি পরিচয়ে তিনি খাওয়ালেন।

আজিজুল হক বলেন, আমাদের পরিচয় এখানে বার্মিজ। আমরা ইচ্ছে করলেও ব্যাঙ্কক যেতে পারি না। তোমাদের তো পাসপোর্ট আছে। তুমি যদি সেখান থেকে মক্কা, মদিনার ছবি, কিংবা আরবিতে আয়তুল কুরসী লেখা বড় বড় পোস্টার এনে দিতে পারো তো আমরা তোমাকে দ্বিগুণ মূল্য দেবো। হাতে তো পয়সা নাই। না খেয়ে মরার দশা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো মূলধনের। পয়সা পাবো কোথায়!

এ পরিস্থিতিতে যে করে হোক দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

তিনি বলেন, গেলাম বিমান অফিসে। সেখান থেকে বললো, টিকিট কনর্ফাম করতে পাঁচশ বাত লাগবে। এরপর গেলাম অ্যাম্বেসিতে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের জন্য। তখন অ্যাম্বেসির বয়সও প্রায় নতুন। আমাদের তো পাত্তা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এভাবে প্রথমদিন হতাশ হয়ে ফিরে আসার পর দ্বিতীয় দিন আবার গেলাম।

সেখানেই একজনকে দেখে চমকে গেলাম। তিনি অ্যাম্বেসির ওয়্যারলেস অপারেটর। আমাদের সঙ্গেই সিটি কলেজে পড়তো। ওর বাবা চাকরি করতো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। বাবার মৃত্যুর পর ও এখানে চাকরি পেয়েছে।

বন্ধুকে দেখে তো আনন্দে আত্মহারা। বাদ দিলাম দেশে ফেরার চিন্তা। ও একা থাকে। সরকারি বিশাল বাসা। মনে পড়ে গেল, ব্যবসার কথা। ওর কাছে টাকা চাইলাম। বললো, মাস শেষে বেতন পেলে তবেই দিতে পারবে। ব্যাস, আমাদের আশ্রয় জুটে গেল। সারাদিন ওর বাসায় থাকি, ঘুমাই। বিকেলে অ্যাম্বেসিতে এসে ব্যাডমিন্টন খেলি। এভাবেই চললো বেশ কিছুদিন।

পরে বন্ধুর কাছে থেকে টাকা নিয়ে চলে গেলাম পাত্তুনাম আর ববে মার্কেটে। সেখান থেকে সাড়ে তিনশ পোস্টার আর কিছু তৈরিপোশাক নিয়ে চলে গেলাম কোতাবারু। তিন হাজার বাতের পণ্য বিনিময় করে পেলাম ছয় হাজার বাত। অনেক টাকা। এন্ট্রি ভিসা নিয়ে এবার দোকানে দোকানে ঘুরলাম।

দেখলাম, যে দামে বিক্রি করলাম তার চাইতে দোকানে দোকানে সরাসরি বিক্রি করলে অনেক বেশি লাভ। তখন একচেটিয়া ব্যবসা করছে ভারতীয় তামিলরা। পরের বার তিন হাজার বাতের পণ্য কিনে বিক্রি করলাম ১৫ হাজার বাতে। বর্তমানে এক বাতের বাংলাদেশি মূল্যমান আড়াই টাকার কিছু বেশি।

এবার দূতাবাসের ওই বন্ধুকে নিয়ে উল্টো আমিই পার্টি দিতে শুরু করলাম।

আজিজুল হক বলেন, নাম বলতে চাইনা। আজকে বাংলাদেশে যারা প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান কিংবা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট তাদের অনেকেই তখন থাইল্যান্ডের সঙ্গে ব্যাগেজ ব্যবসা করতেন।

এবার সঙ্গী বন্ধু তোতলা বাবুল শুরু করলো অন্য ব্যবসা। আমাদের মতো যারা টিকিট ও ভিসা জটিলতায় পড়েছেন কিংবা আটকে আছেন, উদ্যোগ নিলাম তাদের সহায়তার। এতে একদিকে যেমন মানবিক সহায়তা করা হতো, অন্যদিকে নির্দিষ্ট অংকের অর্থও আয় হতো। আবার যাকে দেশে ফেরত পাঠানো হতো, তার সঙ্গে দিয়ে দিতাম ২০ কেজি ওজনের গার্মেন্টস পণ্য। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আমাদের।

তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় আসা-যাওয়ার পথে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দেখলেই সেখানকার ক্যান্টিনে খেতে যেতাম। এভাবে প্রায়ই যেতাম সংখলায় হাজ্জাই ইউনির্ভাসিটিতে। হাই-হ্যালো করতে গিয়ে পরিচয় হলো থাই শিক্ষার্থী ওয়াননা সালাবুনের সঙ্গে। রীতিমতো প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি। যদিও আমি অতটা সিরিয়াস ছিলাম না। এর মধ্যে একদিন বাবা-মা ছেড়ে ওয়াননা সালাবুন দূতাবাসে এসে হাজির। আমাকে বললো, তাকে বিয়ে করতে হবে।

ব্যাস, ক্লংতানের একটি মসজিদে নিয়ে পাঁচজন মৌলভীর উপস্থিতিতে বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো। বিয়ে হলো আমাদের। সে পেলো নতুন নাম- ফরিদা হক।

ইতোমধ্যে, আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে সিলেটের আব্দুল মুক্তাদির ভাইয়ের। বিয়ে করেননি। অসাধারণ মানুষ। দানবীর বলে সবাই তাকে চেনেন। তিন দশক আগে যেমন দেখেছি, এখনো তেমনই আছেন মুক্তাদির ভাই। তখন জাপানে লোক পাঠানোর হিড়িক। কিন্তু মারাত্মক সংকট টিকিটের। সে সময়টাকেই কাজে লাগিয়ে মুক্তাদির ভাইয়ের সহায়তায় শুরু করলাম ট্রাভেল এজেন্সি। আরেক বন্ধু নিয়ামত আলী তালুকদারকে নিয়ে শুরু করলাম থাই–বাংলা ট্রাভেলস এজেন্সি। এই পরিক্রমায় দেশের অনেককে চাকরি দিলাম। তারা প্রতিষ্ঠিত হলো। ধীরে ধীরে শুরু করলাম, কনটেইনার ব্যবসা। তারপর নিজেই হলাম রফতানিকারক আর গাড়ি ব্যবসায়ী। প্রতি মাসে ঢাকায় আমি প্রায় ১০ কনটেইনার ব্র্যান্ডেড প্রসাধনী পাঠাই।

বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আজিজুল হক জানান, এখন ছেলেরাই তার  ব্যবসা দেখে। তিন ছেলে শরিফ তানিম হক, করিম ওরফে নাখাপন, ইয়াসিন ওরফে থিট্রিওয়াটকে পৃথক পৃথক বাংলোবাড়ি ও গাড়ি কিনে দিয়েছেন। এখন তিনি নির্ভার। আর নিজেকে সঁপে দিয়েছেন স্বদেশিদের সেবায়। স্বদেশিদের সম্পর্কে কিছুটা খেদ আর আক্ষেপও রয়েছে তার। এ পর্যন্ত তিনজন স্বদেশি বিশ্বাস ভঙ্গ করে টাকা-পয়সা মেরে পালিয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানার আমোদাবাগ গ্রামের নায়েব আলীর ছেলে আজিজুল হক এখন থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি কমিউনিটির জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। গত ৭ আগস্ট ভিয়েতনামে যাওয়ার পথে থাইল্যান্ডে যাত্রা বিরতি করা রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে প্রবাসীদের নিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছেন তিনি। ব্যবসায়ী দলের নেতা হিসেবেও বাংলাদেশ কী কী পণ্য থাইল্যান্ডে রফতানি করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে কথা বলেছেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে।

এর আগে আব্দুল মুক্তাদির ভাইয়ের উদ্যোগে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সফল করার নেপথ্যের কারিগরও তিনি।

এত শীর্ষে এসেও আজিজুল হক ভোলেননি নিজের কষ্টের জীবনের কথা। প্রায়ই স্মরণ করেন, সেই সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস। টাকার অভাবে দেশে ফিরতে না পারার ব্যথা।

দেশের কাউকে পেলে বুকে জড়িয়ে ধরেন। নিজের ব্যস্ততা এড়িয়ে তাকে সময় দেন। তার সঙ্গে সুখ-দুঃখের আলাপচারিতা। সময় পেলে উড়ে যান দেশের মাটির কাছে। দেশের উন্নয়নে সাধ্য অনুযায়ী নিজেকে নিবেদন করেন তিনি।

আজিজুল হক তার সন্তানদের জানিয়ে দিয়েছেন, সম্ভব হলে মৃত্যুর পর যাতে তার মরদেহ দেশে দাফন করা হয়। আর একটি বিষয়, তিন সন্তানের সবার কাছ থেকেই একটি অঙ্গীকার করে নিয়েছেন। সেটি হলো- তিনি যেভাবে লাভের এক তৃতীয়াংশ দেশে গ্রামের মানুষদের উন্নয়নে পাঠাতেন, ছেলেরাও যেন তা অব্যাহত রাখেন।

এভাবেই ভিনদেশে আজিজুল হক হয়ে উঠেছেন প্রবাসীদের প্রিয় স্বজন। কারো প্রিয় বন্ধু কিংবা তার চাইতেও বেশি আপনজন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৫/আপডেটেড: ১৮৫৫ ঘণ্টা
এবি

** বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাধ্যমে দেশে পর্যটনের বিকাশ ঘটাতে চাই
** কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন কেউ জানে না
** বাণিজ্য ঘাটতির ঊর্ধ্বগতিতে থাই-বাংলাদেশ সম্পর্ক
** বিচারের মুখোমুখি থাইসেনা-পুলিশ কর্মকর্তা
** পাতায়ার ওয়াকিং স্ট্রিটে হাঁটে না দৌড়ায়!
** জাল ভিসা নিয়ে ধরা পড়লেই থাইল্যান্ডে দুই বছরের জেল
** থাইল্যান্ডে স্বদেশিদের স্বজন আদম আলী মীর
** সবার মুখে মুখে ‘লাক মে মাক মাক’
** পাতায়ার ‘ডন’
** বাংলার আলোয় আলোকিত পাতায়া

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

স্পেন এর সর্বশেষ