ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

খেলা

বাংলানিউজের আড্ডায় ফরহাদ টিটো

প্রেসবক্সবন্দি থেকে ক্রীড়া সাংবাদিকতা হয় না

মুশফিক পিয়াল, স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০১৬
প্রেসবক্সবন্দি থেকে ক্রীড়া সাংবাদিকতা হয় না

ঢাকা: ‘সব ধরনের পাঠককে খেলার পাতায় টানতে হলে একজন ক্রীড়া সাংবাদিককে নিজের কলম নিয়ে খেলতে হবে। তবে তার আগে বুঝে নিতে হবে খেলাটিকে।

মাঠ, গ্যালারি, সাইডলাইন, মাঠের বাইরে ক্রীড়ামোদীদের প্রত্যাশা সবটা না বুঝতে পারলে যোগ্য ক্রীড়ালেখক হওয়া যায়না। ’ 

কথাগুলো বলছিলেন ফরহাদ টিটো। বাংলাদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আধুনিক লেখনি যার হাত দিয়ে শুরু ও গতি পেয়েছে সেই ফরহাদ টিটো বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বসেছিলেন আড্ডায়। বাংলানিউজের সভাকক্ষে এই আড্ডা জমেছিলো টানা দেড় ঘণ্টা। আর নির্জলা খেলা ছাড়া আর একটি প্রসঙ্গও ওঠেনি সেখানে। বাংলানিউজের কনসালট্যান্ট এডিটর জুয়েল মাজহার, হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন, আউটপুট এডিটর জাকারিয়া মন্ডল, এসএম সালাহউদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট সাজেদা সুইটি, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর কালাম আজাদ বেগ, হুসাইন আজাদ, স্পোর্টস বিভাগের মুশফিক পিয়াল, রাহাত মাহমুদসহ অন্যরা এই অাড্ডায় অংশ নেন।

যেমন লেখেন, তেমনই বলেন, কানাডা প্রবাসী এই বাংলাদেশি সাংবাদিক । ২০১৫ সালের বিদায়বেলায় (৩১ ডিসেম্বর) নতুন বছরের প্রাক্কালে বাংলানিউজের কর্মীদের নতুন অনুপ্রেরণার উৎস হতেই বুঝি এসেছিলেন তিনি।

‘সব ধরনের পাঠককে স্পোর্টসের মাঝে নিয়ে আসতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলানিউজের কাছে এটাই চাই,’ বললেন ফরহাদ টিটো।

তিনি বলেন, খেলার রিপোর্ট পাঠকগ্রাহ্য করে লেখা সাংবাদিকতার অন্য বিষয়গুলোর মতো সহজ নয়, আর অনলাইন সংবাদমাধ্যমের জন্য তা আরও একটু বেশি কঠিন।

অনলাইনকে তথ্যটাতেই বেশি গুরুত্ব দিতে হয়, কিন্তু তথ্যে ভারি হয়ে থাকা সাদামাটা লেখা ক্রীড়া পাঠকের রুচবে না, সুতরাং এই দুইয়ের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে, আর এটাই চ্যালেঞ্জ।

২০১৪ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের সময় বাংলানিউজের জন্য নিয়মিত কলাম লিখেছিলেন ফরহাদ টিটো। সেই স্মৃতি স্মরণ করে তিনি জানালেন, সেবারই মনে হলো, ইনিয়ে বিনিয়ে নয়, মাত্র দশ লাইনের একটা নিউজ দিয়েও পাঠকের মাঝে নিজের কথা তুলে ধরা সম্ভব। যাতে তথ্য থাকবে, গল্প বলার ঢং থাকবে, আবার শেষও হবে কোনও একটি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য জানিয়ে দিয়ে।

ফরহাদ টিটো বলেন, এ ধরনের লেখায় পাঠকের খেলাটি কিংবা খেলার ভেতরের বিশ্লেষণটি বুঝে নিতে সুবিধা হয়।   

পেছনের স্মৃতিতেও ফিরে যান এই জনপ্রিয় ক্রীড়ালেখক। বললেন, ‘একটা সময় বাংলাদেশে স্পোর্টস রিপোর্টিং যারা করতেন তাদের সামান্য কদরও ছিল না। আমরা দেখতাম, নিউজরুমগুলোতে তাদের জন্য আলাদা করে বসে লেখার মতো কোনো চেয়ার নেই। স্টেডিয়ামে যাওয়া আসার জন্য কোনো বিল দেওয়া হতো না। তাদের অল্প বেতনে কাজ করতে হতো। এমনকি এটাও দেখেছি অফিসের দারোয়ান যেখানে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন, সেখানে স্পোর্টস রিপোর্টারদের বেতন দেওয়া হচ্ছে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। আমরা এ অবস্থা ভাঙতে চেয়েছি। অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছি। আমরা চেয়েছি বাংলাদেশের স্পোর্টস রিপোর্টারদের বিশ্বমানের রিপোর্টার হিসেবে দেখতে। হাস্যকর ব্যবস্থাপনাকে আর আমাদের পরবর্তী জেনারেশনকে এর থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছি। ’

একটু থেমে থেকে টিটো বলেন, ‘আমার মনে হয় তা পেরেছি। বাংলানিউজের স্পোর্টস টিমের দিকে তাকালে, পাতার দিকে তাকালে সে কথা স্বীকার করে নিতেই হবে। পত্রিকাগুলোও এখন দুই পাতা, কেউ চার পাতা দৈনিক খেলার খবর ছাপছে। বড় বড় স্পোর্টস টিম কাজ করছে, এটা দেখতে ভালো লাগে। ’

টিটো আরও বলেন, আমি খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। মাঠের মানুষই বলা যায় আমাকে। মাঠে খেলেছি। আরামবাগ, গোপীবাগ, ব্রাদার্স ইউনিয়নে নিয়মিত আড্ডা দিতাম। আমি জানতাম কেনো একজন রেফারি ভুল করেন, কেন একজন ফুটবলার মাঠে পড়ে গিয়ে অভিনয় করেন, সমর্থকরা কেনো ঢিল ছুঁড়েন, কেনো একজন রিপোর্টার সত্যি খবরটি তুলে ধরতে পারেন না। আর একজন ভালো ক্রীড়া লেখক হতে হলে এগুলো জানতেই হবে।

তবে পরিবর্তনের সূচনা আমরাই করেছি। সব সময়ই চেয়েছি বাংলাদেশের রিপোর্টাররা যেন স্পোর্টসকে বিশ্বব্যাপি তুলে ধরতে পারেন। এক সময় আমি ইংল্যান্ডে চলে যাই। দেশে ফিরে কাজ শুরু করি ‘পরিবর্তনের’ লক্ষ্যে। একটা সেটআপ তৈরি করে তখনকার সময়ে আমি দেখিয়ে দিয়েছি ‘স্পোর্টস’ নামের আলাদা একটি বিভাগ করা যায়। আগে যেখানে স্পোর্টস নিয়ে একটি-দুটি কলাম লেখা হতো, সেখানে আমরা শুরু করি পূর্ণাঙ্গ দুই পৃষ্ঠার ক্রীড়ার খবর।

টিটো চালিয়ে যান, ‘আমাদের কাজ দেখে অনেক পত্রিকার এডিটররা খুশি হলেন। তারাও স্পোর্টস রিপোর্টারদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে লাগলেন। বুঝতে পারলেন স্পোর্টস অবহেলার জিনিস নয়, পাঠকদের এটা আলাদা করে টেনে নেয়। এরপর বাংলাদেশের স্পোর্টস রিপোর্টাররা দেশের বাইরে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে যাওয়া শুরু করেন। ক্রীড়াঙ্গনের সকল সংবাদ তুলে ধরার জন্য তারা আলাদা জায়গা পান। ’

এখনকার ক্রীড়া সাংবাদিকরা ভালো মানের অনেক লেখা লিখছেন, কেউ কেউ অত্যন্ত ট্যালেন্টেড রাইটার বলেই মনে হয় আমার।   তবে, কখনো মনে হয়, এই লেখাটা আগেও পড়েছি। কারণ আধুনিক ধারাটিও এখন স্টেরিওটাইপড হয়ে গেছে। ফলে একই ধরনের লেখাই ঘুরে ফিরে চলে আসছে।

এ অবস্থায় লেখার ধরন পাল্টাতে হবে, অল্প কথায় খেলার মজাটা তুলে ধরাই এখানে খেলা। ততে গল্প থাকবে তত্ত্ব থাকবে, তথ্যও থাকবে, ফের উচ্চারণ করলেন ফরহাদ টিটো।

বললেন, কোনও কোনও স্টোরি শ্রেফ গল্পই থেকে যায়, কোনওটিতে আবার দেখি তথ্যে ভারাক্রান্ত, এর কোনওটাই যেনো না হয়।

প্রেসবক্সে বাক্সবন্দি হয়ে থাকা ক্রীড়া সাংবাদিকের কাজ নয়, তাকে মাঠের সবদিকটাতে যেতে হবে, গ্যালারি থেকে দেখতে হবে, তাতেই একটি ভালো স্টোরি লেখা সম্ভব।  

‘আসলে স্পোর্টস রিপোর্টারদের লিখতে হবে পাঠকদের কথা চিন্তা করে। তারা কি চায়? তাদের বিনোদনের খোরাক দিতে হবে। আমি সব সময় চেয়েছিলাম আমার লেখায় পাঠক বিনোদন খুঁজে পাক। মাঠে বসে খেলা দেখে কিংবা টিভিতে খেলা দেখে যদি বিনোদনের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়, তবে লেখা পড়ে কেন তারা বিনোদন খুঁজে পাবেন না? তাই স্পোর্টস রিপোর্টারদের তাদের কলম নিয়েই খেলতে হবে,’ বললেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫১ ঘণ্টা, ১ জানুয়ারি ২০১৬
এমআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।