সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় তরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল খাগড়াছড়ির এই তিন ফুটবল কন্যা। ফাইনালে দলের ফরোয়ার্ডে আনুচিং মারমা, রাইট ডিফেন্ডারে আনাই মারমা ও সেন্টার মিড ফিল্ডে মনিকা খেলেছিল দুর্দান্ত।
খেলায় ভারতকে ৩-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ পর্ব শেষ করে বাংলাদেশ। এর আগে উত্তর কোরিয়া, জাপান, চীন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও লাওসের মতো দলগুলোর বিরুদ্ধে দুর্দান্ত জয়ে চূড়ান্ত পর্বে ওঠে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুলবল দল।
বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা বিভাগীয় পর্যায়ের খেলায় তিনজনের খেলার কৌশল নজরে আসে রাঙামাটির ক্রীড়া সংগঠক বীর সেন চাকমার। তার তত্ত্বাবধানে আনুচিং, আনাই ও মনিকাকে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয় দক্ষ খেলোয়াড় হিসেবে। ভারতের বিপক্ষে শিরোপা ঘরে এনে দেশজুড়ে পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়িকে আলোচনায় এনেছে তারা।
দেশকে জয় এনে দিলেও নিজেদের দরিদ্রতাকে জয় করতে পারেনি তারা। খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুর্গম সুমন্তপাড়ার মেয়ে মনিকা চাকমা। খেলাধুলা দূরের কথা, মৌলিক অধিকারের অনেক সুবিধাই নেই এ গ্রামে। তবুও নিজের প্রবল ইচ্ছেশক্তি দুর্গম গ্রাম থেকে তুলে এনেছে তাকে।
মনিকা চাকমা বলে, শুরু থেকেই লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ টিমকে আমরা জয়ী করবো। আমরা সবাই জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা দেশবাসীকে জয় উপহার দিতে পেরেছি।
এতোটুকু আসা সহজ ছিল না উল্লেখ করে মনিকা জানায়, আমার ফুটবল খেলতে ভালো লাগলেও পরিবার অনুমতি দিতো না। এলাকায় খেলার পরিবেশও ছিল না। অনেক বাধা পেরিয়ে এতোটুকু আসছি।
একই অবস্থা খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সাতভাইয়া পাড়া সাথোঅং কারবারি পাড়ার যমজ বোন আনাই মারমা ও আনুচিং মারমার। পরিবারে অভাব-অনটন থাকায় জন্মের পরেই তাদের দত্তক দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বাবা-মায়ের।
আনাই-আনুচিংয়ের বাবা রিপ্রুচাই মগ বাংলানিউজকে বলেন, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। খুব কষ্ট করে সংসার, ছেলে-মেয়েদের মানুষ করছি। আগে আমাকে কেউ চিনতো না। এখন দুই মেয়ের কারণে সবাই আমাকে চেনে। প্রতিদিন আমাদের বাসায় বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসে। সর্বশেষ জেলা পরিষদ থেকে ঘর নির্মাণ, ব্রিজ নির্মাণ ও মেয়েদের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
আনাই মারমা ও আনুচিং মারমা বলে, আগে যারা আমাদের খেলাধুলা করতে বাধা দিতো তারাই এখন উৎসাহিত করছে। আমাদের দেখাদেখি অনেক মেয়ে খেলায় আগ্রহ প্রকাশ করছে। আমরা ফুটবলে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে চাই।
এদিকে আনাই, আনুচিং ও মনিকাদের খেলাধুলা দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে তরুণীরা। নিয়মিত খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কিন্তু নারীদের জন্য আলাদা ম্যাচের সুবিধা না থাকায় নিরুৎসাহিত হচ্ছে অনেকেই। তবে খেলা আয়োজনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালেন ক্রীড়া সংস্থা সংশ্লিষ্টরা।
খাগড়াছড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চাকমা জানান, অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দলের তিনজন খাগড়াছড়ির। এটি আমাদের জন্য বিশাল পাওয়া। এখন নারী ফুটবলকে এগিয়ে নিতে আমরা নানা পরিকল্পনার কথা ভাবছি।
পার্বত্য জনপদের তিন কন্যা ফুটবলে অনন্য ভূমিকা রাখায় তাদের পাশে থাকার কথা জানালেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী। তিনি সরেজমিনে আনাই আনুচিংয়ের বাসায় গিয়ে তাদের আর্থিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেন।
এসময় তিনি বলেন, আনাই আনুচিং ও মনিকা দেশের সুনাম যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি খাগড়াছড়িকে গর্বিত করেছে।
তিনি তিনজনের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে ‘এফডিআর’, ঘর মেরামত ও আনাই-আনুচিংয়ের বাসার সামনে ব্রিজ নির্মাণ করার ঘোষণা দেন।
ভবিষ্যতে আনাই, আনুচিং ও মনিকাদের মতো খেলোয়াড় সৃষ্টিতে প্রশাসন এবং স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে বিশ্ব দরবারে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরবে এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৮
এএ