আমি মাঠে কাজ করি, আমি রিকশা চালাই, আমি ট্রাকের ড্রাইভার, আমি হেলপারি করি, আমি নির্মাণ শ্রমিক, আমি গার্মেন্টস কর্মী, আমি তরকারি বেচি, আমি মুদি দোকানদার, আমি ছাত্র। আলাদা আলাদাভাবে আমাদের অনেক পরিচয়।
বলা হচ্ছে-দর্শক দেখতে চায়! কবে, কখন, কোনদিন, কাকে আমরা বলেছিলাম, ‘অশ্লীল ছবি দেখতে চাই’, মনে পড়ে না। ফলে অশ্লীলতার দায় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সামনের খোলা পথটিই আমরা বেছে নিলাম। হয়ে গেলাম হলবিমুখ। ফলাফল, হলঘরে অন্ধকার, সিনেমা হলের দরজায় তালা, পর্দায় মাকড়সার জাল আর চেয়ার ভরা ধূলোবালি। এখন আবার দেখছি আমাদের সিনেমা হলে ডাকার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। নতুন নতুন সিনেমা হল খুলছেন। সিনেমায় ব্যবহার করছেন আধুনিক প্রযুক্তি। চেষ্টা করছেন ভালো সিনেমা বানানোর। চেষ্টা যখন করছেন, তখন নিজের দায় থেকেই আমাদের পছন্দ অপছন্দের কয়েকটি বিষয় তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছি। মনে করছি এ কথা জানানো দরকার, কেমন সিনেমা দেখতে চাই-
আগেই বলে রাখি, আমরা এখন সিনেমাতে তাই দেখছি, পরিচালক যা দেখাচ্ছেন। আমাদের জীবনের কথা বলছে না কোনো সিনেমা। হয়তো বলবেন, ‘আমাদের জীবন তো দুঃখ, দারিদ্র, হতাশা, যন্ত্রণার যাতনায় পিষ্ট। সে জীবনের কথা সিনেমায় টেনে অন্যের মন ভারি করা কেন?’ অত্যন্ত যৌক্তিক আপনার কথা। এ কথাও তো ঠিক- আমরা দুঃখ, দারিদ্র, হতাশাকে জয় করছি ব্যক্তিগত চেষ্টায়।
* শুরুতেই বলে রাখি, ৫০-৭৫ টাকা খরচ করেই আমরা চাই পয়সা উশুল হোক। কোটি টাকা খরচ করে যিনি সিনেমা বানান তিনিও চান তার টাকা উঠে আসুক, সঙ্গে কিছু লাভ। অত্যন্ত যৌক্তিক দু’জনের এ চাওয়া। নাচে-গানে শীষ বাজিয়ে, নায়কের জীবনের সংগ্রাম, পরাজয়, জয়, প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তি দেখে নিজের জীবনের দুঃখ হতাশা ভুলে, পর্দায় মনোরম দৃশ্য দেখে নিজের জীর্ণ দশাকে কটাক্ষ করে, যে যাতনা আমরা সয়ে আসছি জীবনের নানা ক্ষেত্রে, পর্দায় তার প্রতিবাদ করা দেখে উল্লসিত হয়ে আমাদের পয়সা উশুলের বাসনা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়। আর কোটি টাকা যিনি বিনিয়োগ করবেন, তিনিই বা কেন টাকা ঢালতে যাবেন, মুনাফা যদি না আসে।
* চারপাশের মুখ ঢাকা, কমদামি কাপড়ে পেচানো হাড্ডিসার শরীরের নারীমুখ দেখতে দেখতে ক্লান্ত আমাদের চোখ। সিনেমা হলে তাই আমরা দেখতে চাই নারীর শরীর। তাই বলে অতটা উদোম দেখতে চাই না, যাতে চোখ বন্ধ করে রাখতে হয় লজ্জায়। হয়তো বলবেন, ‘এ তো সেক্স! জীবনেরই অংশ। ’ আমরাও বলি, তা ঠিক। তবে আমাদের কাছে এটি এখনও পবিত্র একটি বিষয়। দু’জনের মন বা শরীর আদান-প্রদানের পর যা ঘটে তা পর্দায় নয়, ব্যক্তিজীবনে থাকাই ভালো। আরও একটি কথা বলি, সম্পর্ক ভাঙা-গড়ার এ যুগেও সম্মান করি আমাদের বান্ধবীদের। তাই আমরা চাই না, পতিতাপল্লীর কোনো রমনী আমাদের আমন্ত্রণ জানাক। আমরা চাই, কেউ একজন পরম মমতা ও ভালোবাসায় আমাদের ডেকে বলুক, ‘চলো ভেতরে যাই। ’ সিনেমায় নায়িকার মুখটিও তাই আমরা চাই কোমল, নরম, বালিকাসুলভ, মায়াবি আকর্ষণের হোক, আর চাই তার চাহনি আমাদের হৃদয়কে ভেঙে চুরমার করুক বাস্তবজীবনের প্রেমিকার মতোই।
* আমরা দেখতে চাই বা না চাই, মুক্তি পাওয়ার পরপরই আমাদের দেখা হয়ে যায় ভারতের হিন্দি বাংলা সব ভাষার সিনেমা। কোন সিনেমায় কে কেমন কোমর দোলাচ্ছে? কে তার শরীরের কোন অংশটুকু বেশি দেখাচ্ছে? আর কে কেমন ঢিস্যুম ঢ্যাসুম করছে? তা দেখতে দেখতে যখন বিতৃষ্ণা এসে যায়, তখনই আমরা সিনেমা হলে ঢুকি। দেখতে চাই বাংলা সিনেমাই। যে সিনেমা আমাদের দেশের। যে সিনেমার গল্প আমাদের, কথা আমাদের, ভাষা আমাদের, পোশাক আমাদের, নাচ আমাদের, গান আমাদের। আমাদের সিনেমায় যখন অন্য দেশের কোনো সিনেমার কোনো অংশ নকল করে, অনুকরণ করে, তখন আমরাও মিলিয়ে নিই আমাদের আগে দেখা সিনেমার সঙ্গে। কোন অংশটার সঙ্গে কোন অংশটুকুর কতটুকু মিল, কতটুকু অমিল। কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ। তাই বলি, পয়সা ও সময় খরচ করে আমরা আর ঠকতে চাই না। পারলে নতুন কিছুদিন, নয়তো চেষ্টা করুন। আমরা এতেই খুশি।
* আমরা সাধারণ দর্শক। আমাদের দেওয়ার কিছু নেই। পাওয়ার প্রত্যাশা তাই বেশি। আমরা চাই এমন একটি সিনেমা, যে সিনেমা না দেখলে সত্যি কিছু না দেখা হতো। কিংবা যে সিনেমা দেখার কারণে যে এ সিনেমাটি দেখেনি, তার চেয়ে বিশেষ কিছু দেখেছি বলে ভাবতে পারি। যে সিনেমার গল্প আমি রসিয়ে রসিয়ে বলতে পারবো অন্য কারও কাছে। যে সিনেমার গল্প শুনে আমার অন্য কোনো বন্ধু আফসোস করবে সিনেমাটি দেখতে না পারার যাতনায়। আমরা দেখতে চাই এমন একটি সিনেমা যা দেখতে পারবো পরিবারের সব সদস্য মিলে। যা দেখে আমরা একসঙ্গে হাসবো, হই হই করে উঠবো, কষ্ট পাবো, কান্না করবো, মনে মনে বলবো- ইশ! এমন ঘটনাও ঘটে! কেন ঘটে! আবার পরক্ষণেই ভাববো, ধুত্তোরি! কি ছাই ভাবছি! এতো সিনেমা। যেখানে মারপিট মানেই অযাচিত রক্তারক্তি নয়। যেখানে ভিলেন মানেই শুধু খারাপ গুণের বুদ্ধিসুদ্ধিহীন অমানুষ নয়, মানুষও।
* সিনেমায় আমরা নায়কের মাথা উঁচুই দেখতে চাই। কোনো কারণে কোনো জায়গায় যদি দেখি নায়কের অসম্মান হচ্ছে, নায়কের মাথা নিচু হচ্ছে, নিচু হয় আমাদের মাথাও। তার মানে নায়কের জায়গায় আমি আমাকেই দেখি। নায়কের সুপার পাওয়ারের কিছু অংশ যেমন আমার মধ্যে নিতে চাই, তেমনি আমার জীবনের কিছু অংশ নায়কের জীবনে থাকলে তেমন কী দোষের? তাই আমরা চাই সিনেমার নায়ক শুধু অকল্পনীয় সুপার পাওয়ারের না হোক, হোক আমাদের মতোই রক্ত-মাংসের স্বাভাবিক মানুষ, থাকুক তার একটু এক্সট্রা পাওয়ার।
* আমরা এখন অনেক বড়লোক হয়েছি। বড়লোক যদি না-ও হই সামর্থ্যবান হয়েছি। খেটে খাই। ভালোই কামাই। সিনেমার টিকেট কেনার পয়সা জোটানোর জন্য আমাদের এখন আর ধার করতে হয় না। চুরি করতে হয় না মা বা বোনের জমানো টাকা থেকে। বাবার কাছে বলতে হয় না মিথ্যা কথাও। বাঁচাতে হয় না টিউশন ফিও। সারাদিন কাজ করে যা পাই, তার পাঁচভাগের একভাগ খরচ করলেই আমরা ঢুকে যেতে পারি আশ্চর্য এ সিনেমার জগতে। এক প্লেট ফুচকার দামের মতোই সস্তা একটি সিনেমার টিকেট। ‘খরচ বেশি তাই সিনেমা দেখি না’ একথা কাউকে বলতে শুনি না। ‘হলে সিনেমা দেখার পরিবেশ নেই, তাই যাই না। সিনেমার মান ভালো না, তাই দেখি না’, এসব কথা বলেন অনেকেই। আমরা চাই আমাদের একটু গুরুত্ব দিয়ে শুনুন আমাদের এ কথাগুলো।
* বাংলা সিনেমায় আমরা নাচ দেখতে চাই। সিনেমা দেখে নাচতেও চাই। কিন্তু নাচের নামে নায়ক নায়িকার লম্ফ-ঝম্ফ দেখতে চাই না। দেখতে চাই না ধস্তাধস্তির ফাঁকে শরীরের বিশেষ অঙ্গ।
* শব্দ দুষণমুক্ত একটি সিনেমা চাই। এমন একটি সিনেমা আমরা দেখতে চাই যার প্রতিটি শব্দ নিখুঁত, নির্বাচিত। যার অভিনেতা-অভিনেত্রীর প্রতিটি সংলাপ যথার্থ। কষ্টের প্রকাশ আছে, কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক কান্নাকাটি নেই। আনন্দের উচ্ছ্বাস আছে, কিন্তু অকারণে হট্টগোল নেই। ব্যাকগ্রাউন্ডে পাগল করা মিউজিক যেন আমাদের কানকে অস্থির করে না তোলে।
* বাংলা সিনেমার একটি বিশেষ জনপ্রিয় ফর্মুলা গান। আমরাও চাই গান থাকুক বাংলা সিনেমায়। তবে প্রয়োজনে। অপ্রয়োজনে, অপ্রাসঙ্গিকভাবে নয়। কাহিনী টেনে বড় করার জন্য সিনেমায় গানের ব্যবহার হোক তা চাই না। কিংবা জনপ্রিয় উপাদান রাখার জন্য কাহিনীর সঙ্গে বেখাপ্পাভাবে গান বেজে উঠুক, তা-ও চাই না। আমরা গানের সুরের মুর্ছনায় হারাতে চাই, ভাসতে চাই সুরের সাগরে, ডুবতেও চাই। কিন্তু বুড়িগঙ্গার পঁচা গন্ধযুক্ত ঘোলা জল খেয়ে পেট ফোলাতে চাই না, চাই না বমি করতে। আর চাই, গানের কথাগুলো যেন আমরা বুঝতে পারি। যন্ত্রের বিকট শব্দে গানের কথাগুলো যেন হারিয়ে না যায়।
* হুমকির মুখে বাংলা সিনেমা! চিরকালই তো ছিল। এখনও আছে। তাই বুঝি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলগুলো। আমরা আমাদের মনের আনন্দের জন্যই হুমকির মুখ থেকে ফেরাতে চাই সিনেমাকে। একে ফেরান আপনারাও। একটু ভেবে দেখুন এই দেশের নদী হুমকির মুখে, সবুজ বন-প্রকৃতি হুমকির মুখে। আপনার আমার জীবনও হুমকির মুখে। হুমকির মুখে নারী পুরুষের সম্পর্ক, বিশ্বাসও। বিপন্ন জীবনের সবখানেই তো লেপ্টে আছে বিপর্যয়। এর মধ্যেও তো আমরা স্বপ্ন দেখি, বাঁচি। এই হুমকির মধ্যেই তো কোনো কোনো সিনেমা আশ্চর্যগুণে হচ্ছে ব্যবসাসফল। ২৫ লাখ টাকা খরচের সিনেমা ১৫ কোটি টাকা উশুল তোলার উদাহরণ তো এই বাংলা সিনেমারই আছে।
* সাহিত্যের প্রাপ্তি, মৌলিক গল্প, বঞ্চনার ইতিহাস, জীবনের সংগ্রাম, অর্জনের মুক্তিযুদ্ধ একটি সিনেমার আবহ বা একটি সিনেমার কাঠামো তৈরির জন্য যা যা প্রয়োজন, সবই তো আছে আমাদের। প্রযুক্তি কেনার টাকা, তা-ও আছে। জনপ্রিয় করার রসদ আগে ছিল না, এখন তো আছে। এককালের বাঁধা ধর্মীয় গোঁড়ামি এখন নেই। সংগীত চর্চা এখন আর পাপের নয়; গর্বের, অহংকারের। সিনেমায় অভিনয় করার কারণে এখন আর তিরস্কার জোটে না। সিনেমা নির্মাণের জন্য রাষ্ট্রীয় অনুদান, পৃষ্ঠপোষকতার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান এফডিসি, ডিএফপি, উৎসাহ দেওয়ার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, সংরক্ষণের জন্য ফিল্ম আর্কাইভও আছে, হোক না নামে মাত্র। আমরা বাংলা সিনেমা যাতে দেখি, সেজন্য ইংরেজি বাদে অন্যসব ভাষার সিনেমার বাণিজ্যিক প্রবেশও নিষিদ্ধ আছে। একটি ভালো সিনেমা বানানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সেটাই খালি নেই আমাদের। নিজের উদ্যোগে শিখে শিখে পরিচালক-কলাকুশলীরা যা বানাচ্ছেন, তাতে সিনেমাকে কেউ টেনে আনছেন হুমকির মুখ থেকে। কেউ আবার নিজের অজ্ঞতাবশত সিনেমার সঙ্গে নিজেও হারিয়ে যাচ্ছেন চোরাবালিতে। এভাবেই যদি চলে, আমরা একবার হলমুখী হব, আবার হব হলবিমুখ। আমাদের এই লুকোচুরি খেলা চলতেই থাকবে। তাই বলি কোটি কোটি টাকার এ শিল্পের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দেখুন। ভাবুন সাধারণ দর্শকদের কথা। যারা সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করি, যাদের অনেকেই পরিবারের আত্মীয় স্বজন থেকে থাকি দূরে, মেছবাড়িতে বিছানা ভাগাভাগি করে ঘুমাই, ছুটির দিনে বেশি দূরে ঘুরতে যাই না জমানো টাকাগুলো বাড়িতে পাঠাতে হবে তাই। বড় বড় বিপণি বিতানে কেনাকাটার বিলাসিতা দেখিয়ে অবসর কাটে না যাদের। ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন না দেখে যারা পরের দিনটি নিয়ে ভাবি। আমরা যারা পথের ওপর কাটিয়ে দিই রাতের পর রাত। দেশের ষোল কোটি মানুষের এক কোটি তো হবো আমরা। আমাদের কথা যদি নাই ভাবুন, অন্তত সেই ১০০ জন মানুষের কথা ভাবুন, যারা বছরে অন্তত এক কোটি টাকা করে মোট একশো কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে আমাদের জন্য, মানে বাংলা সিনেমার জন্য। তাদের টাকাটা তো ফেরত দেওয়া চাই।
* আমি বলছি না আমাদের কথা মানতেই হবে। সিনেমাকে জনপ্রিয় করার যাবতীয় মসলা আপনারা মেশাবেন সিনেমায়। কোটি টাকার বাজি বলে তো কথা। তবে মেপে দেবেন। আমরা ভোজনরসিক। মসলা মাখানো খাবার আমরা পছন্দ করি। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মসলা! নিশ্চয়ই না। আরেকটি কথা, ইদানীং বাজারে খাঁটি মসলার চেয়ে গুঁড়া মসলার কদর বেশি। কিছু কিছু মসলায় নাকি থাকে ইটের গুঁড়া। কোটি টাকার পণ্য বলেই বলছি- ভেজালমুক্ত সিনেমা চাই।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০১৪