ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কাছে এক ডজন প্রশ্ন

কেউ কেঁদে, কেউ হেসে, আবার কেউ যৌনতা থেকে বিনোদিত হয়

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৪
কেউ কেঁদে, কেউ হেসে, আবার কেউ যৌনতা থেকে বিনোদিত হয় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী / ছবি: নূর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

আবার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী উন্মাদনা শুরু হয়েছে চারপাশে। তার পঞ্চম ছবি 'পিঁপড়াবিদ্যা'কে ঘিরেই এই উৎসবের আমেজ ছড়িয়েছে।

ইউটিউবে ছবিটির ট্রেলার ধুমসে দেখছে দর্শক। ছবিটিকে ঘিরে আয়োজিত আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া প্রতিযোগিতা সাড়া ফেলেছে। এবার আসল প্রতীক্ষার অবসান হওয়ার পালা। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনা ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার পরিবেশনায় ২৪ অক্টোবর মুক্তি পাচ্ছে ছবিটি। এ উপলক্ষে বাংলানিউজের একডজন প্রশ্নের মুখোমুখি হলেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। দেখা যাক তিনি কী বলেন।

বাংলানিউজ : ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ না হয়ে অন্য বিদ্যাও তো হতে পারতো! ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ই কেনো হলো?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ না হয়ে রসগোল্লাবিদ্যা কিংবা হাতিবিদ্যাও হতে পারতো। কিন্তু হাতির কিংবা রসগোল্লার পাখা গজায় না। যেহেতু পিপীলিকারই শুধু পাখা গজায় সেহেতু বিদ্যাটি পিঁপড়াবিদ্যা হওয়াই বাঞ্চনীয়।

বাংলানিউজ : ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র কোনদিকে দর্শক ফারুকীর জীবনের গল্প পাবে?
ফারুকী :  পরিচালক কোনো ছবি তৈরি করলে তাতে তার জীবনের ছাপ তো থাকেই। তবে আমার ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি আশেপাশে যেসব জীবন দেখেছি, সেইসব জীবনের যন্ত্রণা, আনন্দ, বেদনাকে নিজের বেদনা আর যন্ত্রণা হিসেবেই ধরে নিই। সুতরাং আমার বলা গল্পগুলোতে নিজের দেখা ঘটনাগুলোকে মেশাই। ‘পিঁপড়াবিদ্যা’য় সরাসরি আমার জীবনের ছাপ কোথায় আছে যদি জানতে চান তাহলে দুটি ঘটনা বিশেষভাবে বলতে পারি। একটা হচ্ছে, ছোটবেলায় দেখেছি অপকর্ম করে যদি বাসায় যাই, তাহলে মা বুঝে ফেলতেন। তখন আম্মা খুব গোমরা মুখে তাকিয়ে থাকতেন। তিনি জানতে চাইতেন কী আকাম-কুকাম করেছি! তার কাছে মনে হতো, অপকর্ম করলে আমার চেহারা চোর-চোর লাগে। মায়েরা সন্তানদের মন খুব সুন্দর পড়ে ফেলতে পারে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাইন্ড রিডার হচ্ছেন মা। তেমনি এ ছবির নায়ক (নূর ইমরান মিঠু) অপকর্ম করে এলে তার মা বুঝে ফেলেন। আরেকটা ঘটনা হলো- আমি যখন বেকার ছিলাম তখন আমার প্রিয় কাজ ছিল গুলশান-বনানীতে ঘোরা। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দূতাবাস থেকে ভিসা ফর্ম সংগ্রহ করতাম। তখন চিন্তা করতাম কোন দেশে যাওয়া যায়। মনে হতো, একবার যদি বাইরে চলে যেতে পারি তাহলে তো আর কিছু লাগে না। আবার মাঝে মধ্যে ভাবতাম, যদি কোনো বিদেশিনীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আর তাকে পটিয়ে ফেলতে পারি তাহলে তার সঙ্গে বিদেশে চলে যাওয়া যাবে। এটাও ‘পিঁপড়াবিদ্যা’য় দর্শকরা পাবেন।  

বাংলানিউজ : ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ নিয়ে বিভিন্ন উৎসবে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে দু’চার কথা বলুন।
ফারুকী :  দুবাই, সাংহাই-সহ আরও যেসব উৎসবে আমার ছবিটি গেছে, সবখান থেকেই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। আমাদের ছবি ক্রমাগত বাইরের সম্মানজনক উৎসবগুলোতে গেলে এবং বাঘা বাঘা নির্মাতার ছবির সঙ্গে লড়াই করতে পারলে অগ্রগতি সুনিশ্চিত। বাইরের উৎসবগুলো এখন আমাদের ছবি গুরুত্ব দিয়ে দেখে, এটাও তো কম অগ্রগতি নয়।

বাংলানিউজ : হলিউড রিপোর্টার বলেছে, কোনো না কোনোভাবে ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র বিষয়বস্তু দর্শককে খোঁচা দেবে, মনে হবে কাঁটার মতো বিঁধছে। ছবিটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
ফারুকী :  ছবিটা খুবই মজার। একই সঙ্গে বেদনার ও বিষণ্নতার। এখানে তামাশা, হাস্যরস, বিদ্রুপ এমনকি বিমূর্ত ব্যাপার-স্যাপারও আছে। সব মিলিয়ে এক ধরনের হাহাকার আছে।

বাংলানিউজ : এ পর্যন্ত পাঁচটি ছবি (ব্যাচেলর, মেড ইন বাংলাদেশ, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, টেলিভিশন, পিঁপড়াবিদ্যা) পরিচালনা করলেন। কেউ কেউ মন্তব্য করে, ফারুকী যদি তারকাদের নিয়ে মসলাদার বাণিজ্যিক ছবি বানাতেন, তাহলে ওই ছবি তুমুল ব্যবসা করতো। এমন সম্ভাবনা আছে?
ফারুকী :  আমি তো বাণিজ্যিক ছবিই বানাই এবং দর্শককে বিনোদনই দেই। আমার ছবির দর্শক ভাইবোনেরা যে মাত্রায় ছবিগুলোকে অনুসরণ করে থাকেন তাতে আমি সন্তুষ্ট। বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রতিযোগিতায় যদি ভাবি তাহলে বলবো আমাদের দর্শকরা অনেক আধুনিক। এ ধরনের ছবির প্রতি আগ্রহ আছে একথা বিভিন্ন দেশের বোদ্ধারা শুনলে মনে করে এখানকার দর্শক অনেক অগ্রসর। নেটপ্যাক সেমিনারে কেউ কেউ অবাক হয়ে বলেছেনও, এতো মানুষ এ ধরনের ছবি দেখতে যায়! নির্মাতা হিসেবে কোনো ধরনের ছবির প্রতি আমার অশ্রদ্ধা নাই। অবিশ্বাস থাকতে পারে। বাজারে হাজার রকমের ছবি হবেই। যত বিচিত্র রকমের ছবি হবে ততই আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প সমৃদ্ধ হবে। এবার বিনোদন সম্পর্কে দুটি কথা বলতে চাই। বিনোদন তো নানাভাবে হয়। কেউ কেঁদে বিনোদিত হয়, কেউ হেসে বিনোদিত হয়, কেউ আবার চিন্তা করে বিনোদিত হয়। কেউ কেউ যৌনতা থেকেও বিনোদিত হয়। বিনোদনের নানান আদল আছে। একটা মানুষ যে একভাবেই বিনোদিত হয় তা কিন্তু নয়। সে বিচিত্রভাবে বিনোদিত হতে পারে। একই মানুষ অনন্ত জলিলের ছবি দেখে বিনোদিত হতে পারে, আবার লুই বুনুয়েলের ছবি দেখলেও বিনোদিত হতে পারে। আবার ওই মানুষই শাকিব খানের ছবি দেখে বিনোদিত হতে পারে। বিনোদনের কোনো শেষ নাইরে মনা!

বাংলানিউজ : আপনার কাছে একটি ছবির সাফল্যের মাপকাঠি কী? পুরস্কার জয়, ব্যবসা নাকি দর্শকদের মধ্যে ছবিটা প্রভাব ফেললো কি-না। কোনটা?
ফারুকী :  কোনো একটা নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে আমি ছবির সফলতার বিচার করি না। একটি সফল ছবির অনেক মাপকাঠি থাকতে পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, পুরস্কার পেলে আমি দুঃখ পাই না। আরও দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, পুরস্কার না পেলেও দুঃখ পাই না। আমি ছবি বানাই কারণ কিছু ঘটনা, চরিত্র, আবেগ আমাকে জ্বালায়, পোড়ায়, চুলকায় বলে! আমি ছবি বানাই এসব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি সেই উন্যাসিক নই যে, দর্শকের কেমন লাগলো না লাগলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি যে যন্ত্রণা আর আবেগ থেকে নিষ্কৃতি পাই তা যখন দর্শকের ওপর ভর করে তখন আনন্দ পাই। আমি যা কিছুর কারণে জ্বলি, পুড়ি তা যখন দর্শকের মধ্যে সংক্রমিত হয় তখন আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর একজনও থাকে না। নিজের গায়ের জ্বর অন্যের গায়ে স্থানান্তর করে দিতে পারলে আমার ভালো লাগে। আমার গল্প যখন দর্শকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তখন খুব আনন্দ লাগে। সেজন্যই আমি আমার দর্শককে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু তাই বলে আমি এটা কখনও বলবো না, দর্শকের ভালো লাগা-মন্দ লাগার কথা চিন্তা করে আমার বলবার কথাটা বদলে ফেলি।

বাংলানিউজ : নূর ইমরান মিঠুকে কেনো যুতসই মনে হলো ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র জন্য? এমন আনকোরা একজনকে ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে নেওয়ার সাহস পেলেন কোথায়?
ফারুকী :  প্রথম প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে, ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ দেখতে হবে। মিঠুকে আমি বলি এইটফোর্টি, অর্থাৎ ‘ফোর টোয়েন্টি’র ডাবল! এখানেই বুঝে নিন, সে কতটা ভালো করেছে। হলিউড রিপোর্টার-সহ অনেক বোদ্ধা ছবিটি দেখে মন্তব্য করেছেন, এই ছেলে অসাধারণ কাজ দেখিয়েছে। আর আমি আসলে আমার মনেরে অনুসরণ করি। মনের কথা শুনে বিপথেও যেতে পারতাম। কিন্তু বরাবরই আমি ইতিবাচক ফল পেয়েছি। এজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, প্রকৃতি ও নিয়তির কাছে আমি কৃতজ্ঞ।  

বাংলানিউজ : এ দেশে দর্শকরা মনে মনে নায়কদের যে ভাবমূর্তি ভেবে রাখেন, ‘হিরো হইতে আর কি লাগে’ ভিডিওটি কি সেটার প্রতি বিদ্রুপ?
ফারুকী :  না। এটা পুরোপুরি মজা। ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র বোকাসোকা হিরোকে চেনা নায়কদের হাওয়া লাগাতেই এটা তৈরি করা। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, অন্যদের মজা দেওয়া। পাশাপাশি মিঠুকে চেনানো।

বাংলানিউজ : ‘পিঁপড়াবিদ্যা’য় শিনা চৌহানের কাজ করা নিয়ে নানাজন নানা মন্তব্য করছেন। আপনার ব্যাখ্যা কী?
ফারুকী :  ‘ভারতীয় অভিনেত্রী’ খেতাবটি বিক্রি করে দর্শক টানার কোনো অভিপ্রায় আমার ছিল না। এটা খুব সাধারণ হিসাব। এই উদ্দেশ্য যদি থাকতো তাহলে বলিউড কিংবা ভারতের বাংলা ছবির মূলধারার কোনো নায়িকাকেই নিতাম। সত্যি বলতে ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র চিত্রনাট্য তৈরির সময় বিপিএল চলছিল। আমি টিভিতে খেলা দেখতাম আর স্ক্রিপ্ট লিখতাম। বিপিএল দেখতে দেখতে আমি প্রলুব্ধ হয়ে যাই এবং শিনা চৌহানকে ‘পিঁপড়াবিদ্যা’য় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমি মনে করি, আমার ছবির জন্য ভারতীয় তারকার ভাবমূর্তিকে কাজে লাগানো জরুরি নয়।

বাংলানিউজ : এবার নিজের ছবির প্রচারের ক্ষেত্রে অনলাইনকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে আপনার লক্ষ্য তরুণ দর্শকরা। এটা কি ঠিক?
ফারুকী :  ঠিক ধরেছেন। তাদেরকে আমি বলি অনলাইন সোলজার্স। তারাই দেশ বদলাবে। আর আমার বরাবরই কেনো জানি ভরসা আসে তরুণদের ওপর। আমার ফেসবুক ইনবক্সে শত শত ছেলের মেসেজ পাই। তারা আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলেছে, তারা ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা থেকে একজন লিখেছে, আপনার ছবির প্রচার আপনাকে করতে হবে না, আমরাই করে যাচ্ছি। এসব মেসেজ পড়লে আমি কেঁদে ফেলি। তারা আমাকে যে ভালোবাসা দান করছে এটা আমার পাওনা নয়। এদের ভালোবাসার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, নতুন গল্প বলি। তাদের কথা ভেবেই আমি নতুন নতুন রাস্তায় যেতে ভয় পাই না।

বাংলানিউজ : আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া প্রতিযোগিতা কেমন সাড়া ফেলেছে?
ফারুকী :  প্রচুর সাড়া পড়েছে। পাঁচ হাজার গল্প জমা পড়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১০০টি অভিনব গল্প আছে। দুঃখ হয় যে, সবাইকে বিজয়ী করা গেলো না। তবে এটা আমাদেরকে বলে দেয়, তরুণরা এখন অনেক সৃজনশীল হয়ে উঠেছে।

বাংলানিউজ : শেষ করবো গান দিয়ে। শুধু চিরকুটকে দিয়ে কাজ করালেন এবার। ‘টেলিভিশন’ ছবির ‘কানামাছি’ গানটি জনপ্রিয় হয়েছে বলেই তাদের কাঁধে ভার তুলে দিলেন?
ফারুকী :  না। ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র ‘লেজে রাখা পাখা’ গানটার জন্য যে সাংগীতিক ছোঁয়া চাইছিলাম, তাতে আমার মনে হয়েছে চিরকুট ভালো পারবে। ওই যে বললাম, আমার মনেরে অনুসরণ করি! ‘কানামাছি’ জনপ্রিয় হওয়ায় তাদেরকে এই দায়িত্ব দেইনি। তা না হলে ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’-এ হাবিবের ‘দ্বিধা’ তুমুল জনপ্রিয় হওয়ার পরও ‘টেলিভিশন’-এ তার গান নেই। একইভাবে বলবো, ‘ব্যাচেলর’-এর পর আমি আরেকটা ‘ব্যাচেলর টু’ বানাইনি। নতুন নতুন গল্প বলেছি।

বাংলাদেশ সময় : ২১২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ