ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

মাহফুজ আহমেদের সঙ্গে কিছুক্ষণ

বানাতে পারি না বলেই বাণিজ্যিক ছবি নিয়ে কটু কথা বলি

খায়রুল বাসার নির্ঝর, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৫
বানাতে পারি না বলেই বাণিজ্যিক ছবি নিয়ে কটু কথা বলি মাহফুজ আহমেদ/ ছবি: নূর /বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সময়টা গত বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি। মাহফুজ আহমেদ সিঙ্গাপুরে।

‘জিরো ডিগ্রি’র দৃশ্যায়ন চলছে। এদিকে তার স্ত্রী ইশরাত জাহান কাদের সন্তানসম্ভবা। দিন ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। আর সপ্তাহখানেক পরেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা। এমনই নির্দেশনা দিয়েছিলেন চিকিৎসক। মাহফুজের তীব্র ইচ্ছা- ঘরে নতুন অতিথি আসার সময়টায় স্ত্রীর পাশে থাকবেন। প্রথম সন্তান জন্মের সময়ও পাশে ছিলেন। হাসপাতালে নেওয়া থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার, সন্তানের জন্ম- স্ত্রীর মাথার কাছেই ছিলেন।

একসপ্তাহ আগেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো ইশরাতকে। সিঙ্গাপুরে বসে মাহফুজ খবর পাচ্ছেন- স্ত্রী হাসপাতালে। কাজ ফেলে দেশে আসতেও পারছেন না, আবার দূরেও থাকতে পারছেন না। তার মন উতলা হয়ে আছে, অস্থিরতা বাড়ছে। সে অবস্থায়ই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছেন। একসময় খবর এলো- পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছে। মাহফুজ বলছেন, ‘এ খবর আমার জন্য ছিলো একইসঙ্গে আনন্দ এবং কষ্টের। কষ্টের এ কারণে যে, স্ত্রীর পাশে থাকতে পারিনি। আমার যে কেমন লাগছিলো! চোখ জলে ভিজেছে। ’


‘জিরো ডিগ্রি’র দিনগুলোতে মাহফুজের জীবনে ঘটে যাওয়া এমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা আরও আছে। সানগ্লাস ছিলো একটা তার। খুবই শখের। প্রায় সময়ই চোখে চোখে রাখতেন, সঙ্গে সঙ্গে। সমুদ্রে গানের দৃশ্য করার সময় সেটি হারিয়ে গেলো। সানগ্লাস হারিয়ে মাহফুজের মন খারাপ। ভয়াবহ রকমের মন খারাপ। তার অস্থিরতা টের পেয়ে প্রোডাকশন ম্যানেজার পাংখা মনির সমুদ্রে নেমে গেলেন খুঁজতে। প্রায় দু’ঘণ্টা ব্যাপী খোঁজাখুঁজি পর্ব চললো। কিন্তু সমুদ্র তো আর মনে রাখে না ছোট্ট সানগ্লাসের অস্তিত্ব!

আরেকটি ঘটনা। টাওয়ার বিল্ডিংয়ে দৃশ্যধারণ চলছে। দৃশ্যটা মাতাল হওয়ার। বাচ্চা মারা গেছে, চলে গেছে বউও। মাহফুজ পানে আসক্ত। এমন পরিস্থিতি ফুটিয়ে তুলতে হবে। মাহফুজকে মদ্যপান করে অভিনয়ের জন্য পরামর্শ দিলেন পরিচালক অনিমেষ আইচ। আনা হলো এক বোতল টাকিলা। মাহফুজ খাচ্ছেন আর শট দিচ্ছেন। শেষ হয়ে গেলো পুরো বোতলই। দৃশ্যধারণ শেষ, মাহফুজ বিছানায় পড়ে গেলেন। রাত ৪টা। মাহফুজ বলছেন, ‘৪টার দিকে আমার ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখি অন্ধকারে আমার পাশে দু’জন বসে আছে তখনও। একজন পাংখা মনির, আরেকজন অপু হাওলাদার। এরা আমার ইউনিটের ছেলে। কি যে ভালো লেগেছে ওদের দেখে!’

‘জিরো ডিগ্রি’র দিনগুলোতে ছিলো মাহফুজের এমন অনেক ঘটনার সমাহার। আরও কিছু জানতে ঢুঁ দেওয়া হলো কাকরাইল সিনেমাপাড়ায়। প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরুর অফিসে বসে মাহফুজ ৬ ফেব্রæয়ারির পরিকল্পনা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। ওইদিনই মুক্তি পাচ্ছে ‘জিরো ডিগ্রি’। ছবিটি নিয়ে তার সঙ্গে কথা হলো বিস্তর। কিছু কথা লেখা হলো সাক্ষাৎকারের আদলে।

বাংলানিউজ : আপনি বলেছিলেন, শীত আরেকটু বাড়লে ‘জিরো ডিগ্রি’ আসবে। ‘জিরো ডিগ্রি’ তো এলো। কিন্তু দেশজুড়ে শীত তো কমে আসছে।
মাহফুজ আহমেদ : কনকনে শীতেই আসতে চেয়েছিলাম। মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম জানুয়ারির গোড়ার দিকে। কিন্তু তারিখ পাইনি। পরে সিদ্ধান্ত হলো, জানুয়ারির শেষের দিকে মুক্তি দেওয়া যাক। কিন্তু বিশ্ব ইজতেমার কারণে পিছিয়ে যেতে হলো। অবশেষে এই তো, ফেব্রæয়ারির ৬।

বাংলানিউজ : কিন্তু এখনও তো জটিলতা কাটেনি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি তেমন একটা সুবিধার নয় দেশজুড়ে। হরতাল-অবরোধ-পেট্রোলবোমা-মানুষ পুড়ছে। এর ভেতরেই আপনার ছবি। ভয় লাগছে না?
মাহফুজ : এটা পুরো জাতির জন্যই দুর্ভাগ্যের। মানুষ কতো কষ্ট আর অর্থ ব্যয় করে একটা ছবি বানাচ্ছে; মানুষেরই তৈরি গোলযোগের কারণে সেসব জলে যেতে বসছে। এটা সত্যিই মেনে নেওয়া যায় না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের আশংকা নেই বলা ভুল হবে। আশংকা আছে। তবে এ আশাও আছে যে, সবাই তো একটা ভালো ছবি দেখতে চায়। সে ভালো ছবি দেখার জন্য দর্শক কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করে, দেখি না পরীক্ষা করে!

বাংলানিউজ : আপনি বাংলানিউজকে কয়েক মাস আগে বলেছিলেন, ‘জিরো ডিগ্রি’ নামে যে একটা ছবি আসছে; সেটা দেশের প্রত্যেকটা মানুষ জানবে। সেটি মাথায় রেখেই আপনাদের প্রচারণা। মুক্তির তারিখ তো এগিয়ে এলো। প্রচারণার অবস্থা কী?
মাহফুজ : সারাশহরে বিলবোর্ড উঠে গেছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়েতেও বিলবোর্ড টাঙানো হয়েছে। পোস্টারিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের অংশীদাররাও খুবই গুরুত্ব দিয়ে প্রচারণা করছেন। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের প্রতিটি টিভি চ্যানেলে ‘জিরো ডিগ্রি’র বিজ্ঞাপন প্রচার হবে।

বাংলানিউজ : প্রশ্ন ‘জিরো ডিগ্রি’ নামটা নিয়ে। যত যা-ই বলি না কেন, আমাদের ছবির টার্গেট দর্শক এখনও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর। তাদের বেশিরভাগই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। সে দৃষ্টিকোণ থেকে ‘জিরো ডিগ্রি’ নামটা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে না? বিষয়টা কি ভেবেছেন আদৌ?
মাহফুজ : না। এমন আশংকা নেই। মানুষের জীবন শুরু হয় জিরো থেকে, শেষটাও জিরোতে গিয়ে ঠেকে। সেক্ষেত্রে ‘জিরো ডিগ্রি’কে বলা চলে, আমাদের জীবনেরই গল্প।

[আলাপচারিতার এক পর্যায়ে মাহফুজের মুঠোফোনে এলো আব্দুল আজিজের ফোন। জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তিনি। তারা দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। টপিক একটাই- পাইরেসি। আজকাল প্রথম সপ্তাহেই ছবি পাইরেসির ঘটনা ঘটছে অহরহ। মাহফুজ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। কীভাবে পাইরেসি ঠেকানো যায়, সেটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন বেশ সময় নিয়ে। ]

মাহফুজ : (ফোনালাপ শেষে) ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যাবে, আমি ও রুহি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখছি। এ দৃশ্যের জন্য টিভি ফুটেজের আশ্রয় নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন সরাসরি স্টেডিয়ামে গিয়েই দৃশ্যধারণ করা হয়েছে।

বাংলানিউজ : রুহির প্রসঙ্গই যখন এলো তখন একটা প্রশ্ন করা যেতেই পারে। জয়া আহমেদ ও রুহিকেই কেনো বেছে নিলেন আপনারা?
মাহফুজ : জয়ার বিকল্প জয়াই। সে অসাধারণ অভিনেত্রী। তবে রুহিকে প্রথমে নেওয়ার কথা ছিলো না। পরিকল্পনায় ছিলো পাওলি দাম, রাইমা সেন ও আমাদের চিত্রনায়িকা মৌসুমীর নাম। রাইমা ও পাওলিকে নিয়ে কোনো সমস্যাই ছিলো না। কিন্তু তাদের থাকা-খাওয়া বাবদ যে প্রচুর টাকার দরকার ছিলো, ওই টাকা খরচ করতে আমরা রাজি ছিলাম না। নোবেলজয়ী অর্মত্য সেনের মেয়ে নন্দনা সেনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছিলো। তাকে এবং তার স্বামীকে আমেরিকা থেকে আসা-যাওয়ার খরচ দিতে হবে। এ কারণে আমরা পিছিয়ে গেলাম। এরপর গেলাম মৌসুমীর কাছে। তার সঙ্গে চুক্তিও হয়ে গিয়েছিলো আমাদের। কিন্তু ছোট্ট একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমরা সরে যাই। আমাদের কাছে মনে হয়েছে যে, না করাই ভালো। শেষমেষ আমরা রুহিকে নিলাম। ছবিটা দেখার পর আমাদের মনে হয়েছে, এ চরিত্রের জন্য রুহি সবচেয়ে যোগ্য।

বাংলানিউজ : আপনারা বলছেন, ‘জিরো ডিগ্রি’ পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক ছবি। এ মাধ্যমে কিন্তু একটা বদনাম আছে দীর্ঘকাল ধরে। আপনি, অনিমেষ আইচ- নাটকের মানুষ। নাটকের মানুষ এ মাধ্যমে এসে খুব আহামরি কিছু দেখাতে পেরেছেন, অতীত এমনটা বলছে না।
মাহফুজ : আমার কাছে সেটাই বাণিজ্যিক ছবি, যেটা সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ দেখে। আমি নিজে দেখার জন্য ছবি বানাচ্ছি না। আমি দর্শকদের জন্য ছবি বানাচ্ছি। পুরস্কারের লোভেও বানাচ্ছি না। আমি ছবি বানাচ্ছি- দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য। সে আনন্দ দিতে গিয়ে যদি পুরস্কার পাই, আমি মহাখুশি। আমরা বাণিজ্যিক ছবি বানাতে পারি না বলেই বাণিজ্যিক ছবি নিয়ে কটু কথা বলি। আমরা টেলিভিশন নাটক থেকে যারা সিনেমা করতে আসি, তারা না পারি নাটক ভালোভাবে বানাতে; না পারি সিনেমা বানাতে। আমরা একঘণ্টার নাটককে দুই ঘণ্টা করে সেটাকে সিনেমা হিসেবে চিহ্নিত করি। দর্শকদের সঙ্গে এটা সবচেয়ে বড় প্রতারণা। ছবি প্রযোজনা করতে আসার আগে এসব বিষয় মাথায় নিয়ে নেমেছি।

কথা আরও চললো অনেক। মাহফুজ বললেন ছবিটি নিয়ে নানান পরিকল্পনা আর তার প্রত্যাশার কথা। ‘জিরো ডিগ্রি’তে তিনি কয়েকটি রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছেন। কখনও মুখভর্তি দাঁড়ি, লম্বা চুল, কখনও চুল কামিয়ে একেবারেই টাক মাথা। এ নিয়েও মাহফুজ বললেন, ‘লম্বা দাঁড়ি নিয়ে ঘুরেছি অনেকদিন। বাসায় গেলে আমার মেয়ে আমাকে চিনতে পারেনি। এক বছর ধরে আমি চরিত্রের মধ্যেই ছিলাম। ’ এরপর প্রজেক্টরে দেখালেন ‘জিরো ডিগ্রি’র ট্রেলার।

বাংলাদেশ সময় : ১৯০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ