সম্মুখে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। সাফল্যের উচ্চতায় উজ্জ্বল তিনি।
বাংলানিউজ : ঢাকায় এবার যে ক’দিন কাজ করলেন, কেমন লাগলো?
ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত : ভালোই লেগেছে। শুধু আবহাওয়াটা একটু বেশি গরম ছিলো। এ কারণে শুরুর কয়েকদিন বেশ ঝক্কি গেছে। তবে আজ বৃষ্টির আমেজ থাকায় একটু স্বস্তি পাচ্ছি। কলকাতায়ও বেশ গরম থাকে। এ কারণে ওখানেও খুব একটা মানিয়ে নিতে পারি না। মুম্বাইয়ের আবহাওয়াটা ভালো। গরমটাই যা একটু অসহ্য। ওটা বাদ দিলে কাজ, ইউনিট-সহ বাকি সবই ভালো।
বাংলানিউজ : পরিচালক হিসেবে রাজকে মূল্যায়ন করুন।
ইন্দ্রনীল : খুব ভালো। আমার মনে হয়, কি চায় আর কি না চায় এসব ব্যাপারে ওর ধারণা পরিষ্কার। ওর শট ব্রেকডাউন খুব ভালো। কাজের ক্ষেত্রে রাজকে আমার নতুনধারার নির্মাতা মনে হয়েছে। সমকালীন ঢঙে উপস্থাপন ও দৃশ্যধারণ করে সে। তাই ওর সঙ্গে কাজটা উপভোগ্য লাগছে।
বাংলানিউজ : ছোটবেলায় কি হতে চেয়েছিলেন?
ইন্দ্রনীল : ক্রিকেটার। কিন্তু মডেল হয়ে গেছি। তারপর অভিনয়ে জড়িয়ে গেলাম। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিলো ক্রিকেটার হবো। যেটা হয়ে গেছে তা নিয়ে আমার আফসোস নেই।
বাংলানিউজ : বাবার বদলির চাকুরির সুবাদে গুজরাট, মুম্বাই, মধ্যপ্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরেছেন। সেই অভিজ্ঞতাগুলো কি কাজে লাগে?
ইন্দ্রনীল : হ্যাঁ, ওগুলোর কারণে আমার মধ্যে কোনো একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রভাব নেই। আমার মনে হয়, এটা নানান রকম কাজ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমি এটা উপলব্ধি করি। কলকাতার শিল্পীদের মধ্যে কথাবার্তা, ব্যবহার ও চালচলনে সেখানকার একটা প্রভাব থাকে। এটা থেকে বের হতে না পারলে অনেক ধরনের চরিত্রে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। ভাগ্য ভালো যে, আমার মধ্যে ওটা দেখা যায় না। বিভিন্ন প্রদেশ ঘোরার কারণে আমাকে শুধু মারাঠি, গুজরাটি কিংবা বাঙালি মনে হয় না। বরং সারাভারতের একটা আবহ আছে আমার মধ্যে। এটা অনেক চরিত্রে কাজ করার জন্য বেশ সুবিধাজনক।
বাংলানিউজ : ‘জানালা’য় আপনাকে দেখেছি শৈশবের নস্টালজিয়া ছুঁয়ে থাকা বিমল চরিত্রে। বিমলের মতো আপনার কি ছোটবেলার স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে? বিমলের মতো কি আপনি স্কুলে নির্দিষ্ট কোনো একটা কর্ণারে বসতেন?
ইন্দ্রনীল : কোনো নির্দিষ্ট কর্ণারে বসতাম না। অবশ্যই পেছনে বসতাম (হাসি)। গুজরাতের আহমেদাবাদে আমার স্কুলজীবন কেটেছে। ওখানে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে হয় না। সর্বশেষ গিয়েছিলাম অনেক বছর আগে। নিজের স্কুলকে বারবার দেখতে খুব ইচ্ছে করে।
বাংলানিউজ : বুদ্ধদেশ দাশগুপ্তর মতো প্রখ্যাত পরিচালকের হাত ধরে বাংলা ছবিতে আপনার পথচলা শুরু হয়। সেই জানালাটা কীভাবে খুলেছিলো?
ইন্দ্রনীল : আকস্মিকভাবে! তিনি ইন্টারনেটে আমার স্থিরচিত্র দেখেছিলেন। এরপর তার অফিস থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিছুদিন পর তিনি মুম্বাইয়ে এসে আমার সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন ‘জানালা’য় আমাকে নেবেন। এটা পুরোপুরি হঠাৎ হয়ে গেছে।
বাংলানিউজ : সমরেশ বসুর গোগল চরিত্র নিয়ে বানানো দুটি ছবিতে গোয়েন্দা অশোক ঠাকুর চরিত্রে কাজ করেছেন। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বোমকেশ বক্সী চরিত্র নিয়ে নির্মিত ‘সজারুর কাঁটা’। এখানেও আছেন আপনি। গোয়েন্দা গল্প কি আপনার প্রিয়?
ইন্দ্রনীল : সত্যি বলতে কলকাতার সাহিত্যে বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা চরিত্র আছে। এর মধ্যে ফেলুদা, বোমকেশ, কাকাবাবু, গোগলকে নিয়ে নিয়মিতই কাজ হয়, সেক্ষেত্রে সুযোগ তো থাকেই। আর ছোটবেলা থেকে গোয়েন্দা গল্প পড়তে ভালো লাগে আমার।
বাংলানিউজ : ‘কাহানি’র ভিলেন মিলান দামজি, মিশর রহস্যর ‘হানি আলকাদি’, ‘অটোগ্রাফ’-এর স্বপ্নবাজ পরিচালক, ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’র বাসু, ‘সম্রাট’-এর রাজা- নিজেকে ভেঙেচুরে বহুরূপে হাজির করার প্রস্তুতিটা কেমন থাকে আপনার?
ইন্দ্রনীল : সত্যি বললে কোনো প্রস্তুতি থাকে না আমার! অন্যরা এ বিষয়ে বড় বড় কথা হয়তো বলেন। তাদের অনেকের মুখে শুনেছি- ‘আমি এই করেছি, সেই করেছি। ’ অনেকে আবার জানিয়েছেন, কয়েদির চরিত্রে কাজ করার জন্য জেলে তিন মাস থেকে এসেছেন! অনেকের হয়তো এটা দরকার। কিন্তু আমি এটার প্রয়োজন অনুভব করিনি কখনও। আমার কাছে অভিনয়টা হলো দর্শককে বিশ্বাস করানোর ব্যাপার। চরিত্রটার মতোই আমাকে হতে হবে তা কিন্তু না, তাকে উপস্থাপন করাটাই এখানে মুখ্য। ভালো চিত্রনাট্য যদি থাকে তাহলে ওটা ভালোভাবে পড়া ও বোঝা, পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা এবং তার দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুসরণ করতে পারলে আশি ভাগ কাজ হয়ে যায়। বাকিটা সহায়তা করে গেটআপ। ধরুন হানি আলকাদির কথা, ওই চরিত্রের সাজগোজই আমাকে ৫০ ভাগ তৈরি করে দিয়েছিলো। আমার মনে হয়, চিত্রনাট্যের মধ্যেই চরিত্রের প্রস্তুতি জড়িয়ে থাকে। তাই আজ অবধি আমার মনে হয়নি আলাদাভাবে কোনো প্রস্তুতি দরকার। তবে কোনো চরিত্রের প্রয়োজনে মোটা হতে হলে শারীরিকভাবে ওজন বাড়াবো, আবার রোগা হতে হলে ওজন কমাতে হবে। কিন্তু ভিখিরি চরিত্রে কাজ করতে হলে রাস্তায় ভিখিরি হয়ে ঘুরতে হবে, এই ভাবনাটা আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনোদিন মেনে নিতে পারিনি।
বাংলানিউজ : দুই বাংলার চলচ্চিত্র বিনিময়ের যে ব্যাপারটি সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ইন্দ্রনীল : এটুকু বলতে পারি, বাংলা ছবি বাঙালিরাই বেশি দেখে। কলকাতার ছবিগুলো সেখানে কিংবা বাংলা ভাষাভাষীদের অঞ্চলেই মূলত চলে। ইদানীং মুম্বাইয়ে একটা প্রেক্ষাগৃহে বাংলা ছবির মুক্তি শুরু হয়েছে। সামনে দিল্লিতেও হবে। এভাবে সারাভারত এবং আমেরিকা-সহ বিশ্বের যেসব প্রান্তে বাঙালিরা আছে, সেসব জায়গায় বাংলা ছবি মুক্তি দিয়ে বাজারটাকে বাড়ানো দরকার। একইভাবে বাংলাদেশের বাজারও যদি খুলে যায়, সেক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ছবিরই লাভ হবে। এটা দুই দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্যই ইতিবাচক। ঢাকার ছবি যদি পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পায়, তাহলে এখানকার বাজারও বাড়বে। একইভাবে আমাদের কলকাতার ছবিও যদি এখানে নিয়মিত মুক্তি পায়, আমাদের দর্শকও বেড়ে যাবে। দু’দিকের ছবির আদান-প্রদান হলে দুই বাংলারই লাভ।
বাংলানিউজ : আপনি মানুষটা কেমন? রেগে যান কখন?
ইন্দ্রনীল : আমি খুব শান্ত মানুষ। আর জীবনে শৃঙ্খলা মেনে চলি। ঘড়ি মেপে কাজ করি। একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠি, শরীরচর্চা করি আবার কাজের জন্য বেরিয়ে পড়ি। তাই আমি চাই একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হয়ে যাক। তারপর বাড়ি ফিরি, খাই, ঘুমিয়ে পড়ি। যখন মনে হয় কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া আমার সময়ানুবর্তিতাকে ব্যাহত করা হচ্ছে, তখন ভীষণ অসন্তুষ্ট হই। এটা আমার সমস্যা, তখন আমি রেগে যাই। যৌক্তিক কারণে হলে আলাদা কথা। আমার সব জিনিসই নিখুঁত আর যুতসই হওয়া চাই।
বাংলানিউজ : খ্যাতিকে কীভাবে দেখেন?
ইন্দ্রনীল : আমি চেষ্টা করি, খ্যাতির বিষয়টা যতটা না অনুভব করে থাকা যায়। কারণ এটা অস্থায়ী বিষয়। খ্যাতি হলো আজ ছবি চললে ভক্তরা আপনার অটোগ্রাফ নেবে, সেলফি তুলবে, দৌড়ে-দৌড়ে আসবে। কাল দু’তিনটি ছবি ফ্লপ হলে কেউ তাকাবেও না। তাই এটা খুবই অস্থায়ী একটা বিষয়। এটাকে মাথার ভেতর গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত নয়। সাফল্য-ব্যর্থতা দুটোই আমাদের পেশার অংশ। ব্যর্থতাকে নিয়ে হতাশ হই না আমি। কারণ বেশিরভাগ ছবিই তো ফ্লপ হয়। তাই সফল কোনো ব্যাপার ঘটলেও বেশি নাচানাচি করি না।
বাংলানিউজ : এমন কেউ আছেন যার সহযোগিতা না পেলে এতোদূর আসতে পারতেন না?
ইন্দ্রনীল : অবশ্যই। মডেল হিসেবে কাজ করার সময় অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ছিলো। তখন যদি আমার মা-বাবা আমাকে আর্থিকভাবে সহায়তা না করতেন তাহলে মুম্বাইয়ে টিকতেই পারতাম না। আমার স্ত্রীরও (বরখা বিশত) অনেক অবদান আছে। এখনও বেশিরভাগ সিদ্ধান্তেই ওর ভূমিকা থাকে। আমরা সবকিছুই আলোচনা করি। কতো টাকা নেওয়া উচিত, কতো নেওয়া উচিত না কিংবা কতোদিন কাজ করা উচিত, কতোদিন কাজ করা উচিত না- এমন সবকিছুতে ওর মতামতকে গুরুত্ব দেই। আর আমার মনে হয়, বাস্তবিক ব্যাপারগুলো আমার চেয়ে ভালো বোঝে ও।
বাংলানিউজ : অভিনয়ের মজা কোথায়?
ইন্দ্রনীল : চলচ্চিত্রের কথা বলি। একটা হলো, প্রতিটি ছবিতে আমরা নতুন মানুষ হয়ে যাই। চিকিৎসক, খুনি, ধর্ষক কিংবা বিজ্ঞানী-সহ নানান চরিত্র হয়ে যাই! এর চেয়ে মজার কিছু হতে পারে না। একটা নতুন মানুষ হয়ে ৩০-৩৫ দিন থাকার রোমাঞ্চ কাজ করে অভিনয়ে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটার কোনো শেষ নেই। কোনোদিনই মনে হবে না, আমি ভালো অভিনেতা বা ফাটানো অভিনয় করি। কখনও এটা মনে হলে এমন একজন সামনে দাঁড়াবে, তার অভিনয় দেখে মনে হবে- ধুর আমি তো কিছুই পারি না! আবার হলিউড কিংবা ওয়ার্ল্ড সিনেমার ছবি দেখলে মনে হবে ডুবে যাই জলে, লজ্জায়! তাই এটার কোনো শেষ নেই। আপনি কোনোদিনই এমন একটা জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন না যে, ভাবতে পারবেন সব পারি। অভিনয় এমন ব্যাপার, সবসময়ই মনে হয় কিছুই পারি না। প্রতিদিন, প্রতিটি দৃশ্যে কাজ করার সময় মনে হয় আরও ভালো হতে পারতো।
বাংলানিউজ : ‘অটোগ্রাফ’ ছবিতে পরিচালক শুভব্রতর ভূমিকায় আপনার অভিনয় ভালো লেগেছে। শুভব্রত যেমন সত্যজিতের ‘নায়ক’ রিমেক করতে চায়, ‘অংশুমানের ছবি’তে অংশুমান ছবি বানাতে চায় চিত্রশিল্পী ও নার্সের সম্পর্ক নিয়ে। পরিচালক হলে আপনি কি বানাবেন?
ইন্দ্রনীল : এখনও মানসিকভাবে নিজেকে পরিচালনার জন্য প্রস্তুত মনে করি না। এ কাজটা করার ইচ্ছে হয় না। অবশ্য ভবিষ্যতের কথা বলা যায় না। তবে পরিচালক হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।
বাংলানিউজ : আবার জন্মালে কি হতে চান?
ইন্দ্রনীল : আমি ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তই হতে চাই। নিজেকে নিয়ে আমি খুশি। আমার পরিবার, সহকর্মী, দেশ-সহ আমি যা যা পেয়েছি, সব নিয়ে সন্তুষ্ট। তবে পুনর্জন্ম ৫০০ বছর পর হলে ভালো হবে, তখন আমার দেশটাকে আরও উন্নত দেখতে পারবো!
বাংলানিউজ : মীরার গল্প বলুন।
ইন্দ্রনীল : মীরা এখন খুব দুষ্ট হয়ে উঠেছে। ওর বয়স সাড়ে তিন বছর। বেড়ে ওঠার পাশাপাশি আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক আরও নিবিড় হচ্ছে। বাড়ি না থাকলে ওকে ভীষণ মিস করি। ঘরে থাকলে আমার আর বরখার ছবি রোজই দেখে ও। তবে চরিত্র ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক তা এখনও বোঝে না।
বাংলাদেশ সময় : ২১০০ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৫
জেএইচ