ফেনী : একটা সময় ছিল, যখন সিনেমা হলগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকতো না। বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম চলচ্চিত্র হওয়ায় স্বভাবতই এর দর্শক চাহিদাও ছিলো প্রচুর।
ফেনীতে সিনেমা হল ছিলো চারটি। লোকসানের ভার বইতে না পারায় ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে দুটি। ২০০৩ সালে সুরতমহল সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে এখন বিপণি বিতান। হলটির মালিক বাচ্চু মিয়া জানান, লোকসানের কারণে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাচ্ছিলো না। তাই বন্ধ করে দিতে হলো। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে বন্ধ হয়ে যায় শহরের একাডেমী এলাকায় অবস্থিত বিলাসী সিনেমা হল। এর মালিক আবদুল মান্নানেরও একই কথা- লোকসানে টিকে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফেনীর বাকি দুটি সিনেমা হল টিকে থাকলেও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ‘কোনো শোতে পাঁচজন, কোনোটাতে ছয়জন, আবার কোনোটাতে দর্শক শূন্য থাকে সিনেমা হল। এভাবে তো আর চলে না’- বলছিলেন ফেনী রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় অবস্থিত দুলাল সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক ওলিউল্লাহ দুলাল। তিনি জানান, সময়টা বেশিদূরের নয়, যখন দর্শকে মুখর থাকতো সিনেমা হল। প্রতি শোতে দর্শক থাকতো দুইশ’র ওপরে, সারা মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আয় করা যেত, পেট চলতো অর্ধশতাধিক কর্মচারির। কিন্তু এখন সারা মাসে ৮-১০ হাজার টাকাও আয় করা সম্ভব হয় না, কর্মচারি ও যাবতীয় খরচ মেটানোর পর লাভ তো দূরের কথা, উল্টো গুনতে হয় লোকসান। এ ব্যবসায় টিকে থাকাই যেন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একই ধরনের অভিমত কলেজ রোড এলাকায় অবস্থিত কানন সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক আরজু মিয়ার। তিনি বলেন, ‘এখন আর আগের মতো ব্যবসা নেই, কোনোরকম পেটে-ভাতে বেঁচে থাকা। ’ তিনি অবশ্য এজন্য দায়ী করেছেন ভারতীয় চ্যানেলের সিনেমা এবং সিরিয়ালকে। তার মতে, ‘মহিলারা এখন সারাদিন ভারতীয় সিনেমায় মজে থাকে, সিনেমা হলে এসে ছবি দেখার সময় কোথায় তাদের? এখনকার ছবিগুলোর দর্শক খেটে খাওয়া মানুষ রিকশা ও ভ্যান চালকদের বিশাল একটা অংশও মোবাইল ফোনে তাদের বিনোদন খুঁজে নেয়। ’

কিন্তু দুলাল হলের ব্যবস্থাপক ওলি উল্লাহ প্রকাশ করেছেন ভিন্নমত। তিনি মনে করেন, এ শিল্পে ভালো শিল্পীর সংকট চলছে। শাকিব খান-অপু বিশ্বাসকে দিয়ে আর কয়দিন? এ ছাড়া ছবির মানও খুব নিম্নমানের। ছবির মান ও শিল্পীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে দর্শকরা সিনেমা হলে আসতে উদ্বুদ্ধ হতো।

মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) সকালে গিয়ে দেখা যায়, দুলাল সিনেমা হলে ৯-১২টার শোতে চলছে অমিত হাসান ও আলেকজান্ডার বো অভিনীত ‘দুই মাস্তান’। এ শোতে দর্শক পাওয়া গেছে সর্বসাকুল্যে ছয়জন। দুপুর ১-৩টায় কানন সিনেমা হলে চলছে শাকিব খান-শাহারা অভিনীত ‘রুখে দাঁড়াও’। এ শোতে পাওয়া গেছে সাতজন দর্শক।

সিনেমা হলে দর্শকবিমুখ হওয়া প্রসঙ্গে ফেনী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র শরীফুল আলম বাংলানিউজকে জানান, ১৫ থেকে ২০ বছর আগে প্রেক্ষাগৃহগুলো ছিলো দর্শকে ভরপুর। ওই সময় সাধারণ মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে সিনেমা হলে যেতেন ছবি দেখার জন্য। কিন্তু এখন আর তা দেখা যায় না। হলগুলোর অব্যবস্থাপনা আর ভেতরকার অপকর্মের কারণে সিনেমা হলে যাওয়াকে এখন নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। কেউ এটাকে এখন ভালো চোখে দেখে না। এ ছাড়া হলের আসন, পর্দা ও শব্দব্যবস্থাপনার বেহাল দশা তো আছেই।

পংকজ দাস নামের ফুড প্রোডাক্ট কোম্পানির এক এরিয়া ম্যানেজার জানান, আগে একটি টিকিটের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে টিকিট পাননি। কিন্তু আজ সেই চিত্র নেই, সিনেমা হল এখন দর্শক শূন্য। দর্শক না হওয়ার পেছনে কারণ হলো অব্যবস্থাপনা এবং হলের ভেতরকার নেতিবাচক কর্মকান্ড। এর পেছনে তিনি আবার আকাশ সংস্কৃতিকেও দায়ী করছেন। তার দাবি, দর্শক এখন সিনেমা হলে এসে টাকা খরচ করে সিনেমা দেখতে নারাজ। কারণ এখন প্রায় সবার বাড়িতেই টেলিভিশন রয়েছে। তাতে স্যাটেলাইট সংযোগ থাকায় অনায়াসে দিনভর চলচ্চিত্র দেখতে পারছেন তারা। ভালো সিনেমা নির্মাণ না হওয়াও মানুষকে হলবিমুখ করেছে বলে মন্তব্য তার।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ফেনী জেলা শাখার সভাপতি মাহবুবু আল-তমাস মনে করেন, রুচিশীল সিনেমা তৈরি হলে অবশ্যই দর্শক সিনেমা হলে আসবে। যেমন- ‘মনপুরা’, ‘আগুনের পরশমনি’, ‘মনের মানুষ’ ছবিগুলো দেখার জন্য মানুষ সিনেমা হলে এসেছে। তিনি মনে করছেন, সিনেমা হলগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হলে নির্মাতাদের ভালো ছবি নির্মাণ করতে হবে। সরকারেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা উচিত, যেন দর্শক আবার সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার উৎসাহ পায়।

বাংলাদেশ সময় : ১৯০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৬
এসডিএইচ/জেএইচ