ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

‘সবাই প্রেম করুন’

সোমেশ্বর অলি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৬
‘সবাই প্রেম করুন’ অঞ্জন দত্ত/ছবি: নূর- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

অঞ্জন দত্ত বুড়িয়ে গেছেন। এই প্রসঙ্গটা তিনিই এনেছেনে গান করার ফাঁকে ফাঁকে।

‘আমার বয়েস কতো বলেন তো!’ দুই-দু’বার এই প্রশ্ন ছুঁড়েছেন দর্শকের উদ্দেশে। সত্যি কী অঞ্জন তারুণ্য হারিয়ে ফেলেছেন? উত্তর খুঁজুন লেখার শেষ দিকে।

দর্শকসারি পূর্ণ। ঘোষণা অনুযায়ী মঞ্চে এলেন উপমহাদেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী অঞ্জন দত্ত। এলেন দল নিয়ে, আঁধারে। করতালি আর সিঁটি কানে তুললেন না। সবাই মিলে মঞ্চের যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক জায়গায় রাখলেন। অন্ধকারে বোঝা গেলো একজন অবশিষ্ট, অন্যরা ফিরে গেছেন সাজঘরে। অন্ধকারে বোঝা গেলো, ক্যাপটা ঠিক করলেন, মাইক্রোফোন আর মুখের দূরত্বটাও মেপে নিলেন।

একটা গিটার ততোক্ষণে বেজে উঠেছে, ওমনি আলো ফুটলো তার মুখে। সানগ্লাসে ঢাকা চোখ দুটো জেগে উঠলো। দু’তিন মিনিট গেছে কি-না, তৃতীয়বারের মতো হাততালি পেলেন অঞ্জন। গিটার বাজাতে বাজাতে গাইছেন, ‘আমার জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায়…’।  

একা শুরু করলেন অঞ্জন, গান টেনে নিলেন ভক্তরা। সমবেত সংগীত হয়ে উঠলো এটি। দর্শকই শেষ করলেন প্রথম গানটি। গান শেষ করে আনুষ্ঠানিকতায় এলেন তিনি। ‘সবাইকে অনেক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা। এ শহরে প্রথম আসি অনেক বছর আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা প্রোগ্রামে গেয়েছিলাম। এরপর গানের টানে এসেছি অনেকবার। কোনোদিন টাকা নিয়ে গাইবো ভাবিনি। ’

এরপর মজার একটি অভিজ্ঞতা জানিয়ে অঞ্জন দত্ত বললেন, ‘একজন আমাকে একবার দাওয়াত দিয়ে বলেছিলো, আমাকে তিনি কিছু খাওয়াতে চান। আমি কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, আমার প্রথম অ্যালবামটি এখানে ছয় লাখ কপি বিক্রি হয়েছিলো। তিনিই এ কাজটি করেছিলেন। আমি তো জানতামই না! সে যাই হোক, সত্যি বলতে গান করে আমার দেশের চেয়ে এখানে একটু বেশিই পেয়েছি। ’

দ্বিতীয় গান ধরবেন অঞ্জন। ততোক্ষণে মঞ্চে এসেছেন অন্যরা। লিড গিটারে অমিত দত্ত, যাকে বলা হয় ‘গিটার গড অব ইন্ডিয়া’, রিদম ও লিড গিটারে নীল দত্ত, তিনি অঞ্জনের সুযোগ্য পুত্র, বেজ গিটারে সৌমিক এবং ড্রামসে দেবব্রত বক্সী।

‘হ্যালো বন্ধু আমাদের এই দূরে দূরে থাকা হোক শেষ/গানে গানে কেটে যাবে আরও একটা রাত/ হ্যালো বাংলাদেশ…’। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একটি মিশ্র অ্যালবামে অঞ্জন গেয়েছিলেন গানটি। দর্শকদের অংশগ্রহণ দেখে মনে হলো এটাও বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে এই গানটা করবেন না- তা হতে পারে না।

তৃতীয় গানে এসে অঞ্জন খোলস থেকে বেরিয়ে এলেন যেন। রক ঘরানার গান ‘তুমি আসবে বলে তাই’ গাওয়ার সময় পুরো মঞ্চে ছড়িয়ে পড়লেন তুখোড়-তরুণ এক গায়ক। বয়সের অঙ্কটা মাথায় না রাখলে এমনটা বোধ হওয়াই স্বাভাবিক। এরপর গাইলেন ‘মিস্টার হল’ গানটি। এবারও দর্শক অংশগ্রহণ করলেন গলা মিলিয়ে। এই গলা মেলানোয় সাময়িক বিরতি এলো ‘ম্যারিয়েন’ শেষ করার পর।

অঞ্জন গানের ফাঁকে কথা বলতে পছন্দ করেন। রাজধানীর ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের মিলনায়তনেও ব্যতিক্রম ঘটলো না। রোববার (১৪ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টা ১৮ মিনিটে মঞ্চে উঠে দ্বিতীয়বার বললেন ভালোবাসা নিয়ে কিছু কথা- ‘আজ স্পেশাল একটা দিন। যারা প্রেমে আছেন, যারা প্রেমে নেই, যারা আর কখনও প্রেম করবেন না বলে ভাবছেন, তাদের সবাইকে বলছি, প্রেম করুন…’। হলভর্তি দর্শক-শ্রোতা অঞ্জন দত্তের এই প্রস্তাবে খুশি। আবারও পড়লো করতালি।

নীল দত্ত যে গান করেন, এখানকার অনেকেই সেটা জানেন। বাবার ‘চ্যাপ্টা গোলাপ’ গানটা তিনি যখন ধরেছেন- অনেকেই ভেবেছেন অঞ্জনই হয়তো গাইছেন। এ সময় সাময়িক বিরতির জন্য মঞ্চ ছেড়েছেন অঞ্জন। নীল এরপর গেয়েছেন নিজের সুরে শানের গাওয়া ‘আমার প্রথম দেখা বৃষ্টির জলে’ গানটি।

ছেলের গানের পরিবেশনা সাজঘর থেকে শুনছিলেন অঞ্জন। দর্শকসারি থেকে প্রস্তাব উঠেছিলো বাবার গান নয়, নিজের গান গাইতে হবে নীলকে। এটাও নিশ্চয়ই শুনেছিলেন বড় দত্ত!

মঞ্চে ফিরে একটু উষ্মা ঝাড়লেন অঞ্জন, ‘আমি তাহলে একটা কবীর সুমনের গান গাই?’ সবাই তাকে বাহবা জানালেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে বসলেন ‘রঞ্জনা’র প্রেমিক। ‘একটু আগেই নীলকে বলা হলো বাবার গান না গাইতে। আমি কেন সুমনের গান, রবীন্দ্রনাথের গান, বব ডিলানের গান গাইবো?’ অঞ্জনের যুক্তিতে হইচই পড়ে গেলো। এ যুক্তির ব্যাখ্যাও দিলেন তিনি, ‘সবার গান সবাই গাইবে। এটাই হওয়া উচিত। ’

কথার ঝাঁপি বন্ধ হলো। এবার ভিন্ন আঙ্গিকে শুরু হলো পরিবেশনা। ড্রামস বন্ধ। শুধু তিনটি গিটারের আবহে গেয়ে শোনালেন ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’। অন্যরকম দ্যোতনা মিললো গানটিতে। এরপরই ‘রকার’ ও ‘তরুণ’ অঞ্জনের আবারও ফিরে আসা। ‘পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোড়া করে দেবো’ তথা ‘রঞ্জনা’কে নিয়ে রীতিমতো নাচ শুরু করলেন অঞ্জন। অদ্ভুত মুদ্রায় তার নাচ দর্শকের বাড়তি আনন্দ দিয়েছে- বোঝা গেলো তুমুল করতালি আর সিঁটিতে।

অঞ্জন দত্তের সংগীতজীবন ২৪ বছরের। তার বয়স কতো? প্রশ্নটা নিজেই ছুঁড়লেন দর্শকের উদ্দেশে। রসিকতা করে কেউ কেউ বললেন ‘১৫’। মানলেন না তিনি, হাসলেন। তিনি জানালেন, ৫৯ বছর বয়সে নতুন গান বেঁধেছিলেন। সেটাই গাইবেন এখন। সেই বিচারে ষাট পেরিয়েছেন সেই কবে! শুরু হলো ‘এখনো তাই’ গানটি। এরপর ‘খাদের ধারের রেলিং’ পরিবেশনের আগে জানালেন, এটি লিখে তার ভালো লেগেছিলো খুব। এমন গান তার কমই আছে। এরপর আবার গাইলেন নীল। বাবার ছবি ‘দত্ত বনাম দত্ত’ থেকে তিনি শোনালেন ‘তবু যদি তুমি আসতে চাও’।

এরপর অঞ্জনের কণ্ঠে ‘টু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন’। যথারীতি উন্মাদনা সবার মধ্যে। আসতে শুরু করেছে অন্যান্য হিট গানের অনুরোধ। এবার একটু যেন বিরক্তি বোধ করছেন অঞ্জন। একের পর এক গানের অনুরোধ। তিনি জানালেন, পুরনো গান নয়, তার পরিণত বয়সের গানও শোনা উচিত। এখনকার চিন্তাগুলো কেমন সেটা পরখ করা চাই। অল্প বয়সে অনেক লিখেছেন।

অঞ্জন জানালেন, একসময় তিন ঘণ্টা টানা শো করতেন। এখন তেমন পারেন না। আবারও জানালেন তার বয়স হয়েছে। ‘কতো কিছু করার ছিলো যে’ গানটা গাইতে গাইতে হাত ইশারায় মঞ্চ ত্যাগ করলেন। কিছু দর্শক নড়েচড়ে বসলেন। মঞ্চে অন্য বাজিয়েরা তখনও আছেন। অনেকে ভাবছেন, তিনি আবারও ফিরবেন।

ঠিকই ফিরলেন অমিত দত্তের জ্যামিং শেষ হওয়ার পর। কিছুক্ষণ পর পর এই গিটারশিল্পীর ‘বাদন’ দেখে ‘অস্থির’ বোধ করেছেন দর্শকরা। অঞ্জন দত্তের এদিনের পরিবেশনায় বাড়তি আনন্দ দিয়েছেন অমিত দত্ত। অমিত যে উঁচু দরের গিটারবাদক, সে প্রমাণই রাখলেন তিনি।

ধারণা ঠিক, ফিরে এলেন ‘বেলা বোস’-এর প্রেমিক অঞ্জন। আবার খুললেন কথার ঝাঁপি। বয়স কতো জানতে চাইলেন দর্শকের কাছে। একেক জন একেক উত্তর দিলেন। অঞ্জন নিজের বয়স যে বেশি সেটা প্রমাণ করার জন্য মাথার ক্যাপ ছুঁড়ে ফেললেন মঞ্চের একপাশে। খুললেন সানগ্লাসও। বললেন, ‘যাইনি আসলে। আরও গান করবো। বয়স হয়েছে তো। তাই চলে যাওয়ার রিহার্সেল করলাম!’

আবার নতুন উন্মাদনায় সংগীত পরিবেশন শুরু করলেন অঞ্জন। শেষ গান এলো আরেকটু পরে। ‘তুমি না থাকলে’ গানে শেষবারের মতো যেন মেতে উঠলো সবাই। একই গানে বাজিয়েরা নিজেদের কারিশমা দেখালেন। নীল দত্ত গিটারে তুললেন আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’ গানের সুর। আবার সবাই মিলে ফিরলেন ‘তুমি না থাকলে’তে। শেষ গান পরিবেশনে প্রায় ১০ মিনিট সময় নিলেন তারা।  

 এতোগুলো গান চললো একনাগাড়ে। একবারের জন্যও সবাই মিলে একসঙ্গে মঞ্চ ছাড়েননি অঞ্জন বাহিনী। অঞ্জনকে একবারের জন্যও লিরিক দেখতে হয়নি। দেখবেনই বা কোথায়? সামনে তো লিরিক স্ট্যান্ড বলে কিছু ছিলোই না! গান পরিবেশনার বেলায় একটুও মনে হয়নি যে, অঞ্জন দত্ত ক্লান্ত বা সুর ভুলে গেছেন। এরপরও কী আপনি বলবেন যে, অঞ্জন দত্ত বুড়িয়ে গেছেন কিংবা তারুণ্য হারিয়ে ফেলেছেন? যারা ‘অঞ্জন দত্ত লাইভ ইন ঢাকা’ উপভোগ করেছেন তারা ঠিক ধরেছেন যে, এসবই ছিলো অঞ্জন দত্তের রসিকতা কিংবা অভিনয়। শুধু মঞ্চ নয়, কে-না জানে পর্দাতেও তুখোড় অভিনয় করেন অঞ্জন।

সভ্যতা ও সন্ধি, যুগলবন্দি
রেড ভেলভেট ইভেন্টস আয়োজিত এই কনসার্ট শুরু হয় সন্ধ্যায়। শুরুতে পরিবেশনায় অংশ নেন গানের ব্যতিক্রমী জুটি সভ্যতা ও সন্ধি। সম্পর্কে তারা ভাইবোন। নিজেদের ব্যান্ড মহাকালের পাশাপাশি তারা গেয়ে শোনান অন্য শিল্পীদের জনপ্রিয় গান। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন আরজে নীরব।    

বাংলাদেশ সময় : ১৪১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৬
এসও/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ