ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

প্যারিসে মোমের তারাদের ঘোরে 

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৬
প্যারিসে মোমের তারাদের ঘোরে  ছবি : মামুন আবীর ও ফরিদ আহমেদ রনি

কান থেকে প্যারিস এসে পৌঁছেছিলাম ২৩ মে। গত বছর হাতে মাত্র একদিন  থাকায় ঘোরা হয়নি খুব একটা।

কিন্তু এবার ঢের সময়! ওইদিন রাতে প্যারিস প্রবাসী বাংলাদেশি ফরিদ আহমেদ রনির বাসায় পরিচয় হলো সাব্বির আহমেদ রিপনের সঙ্গে। তিনি ১৮ বছর ধরে প্যারিস প্রবাসী। বাংলাদেশের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেডের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে তার বেশ খাতির। প্যারিসে এলে বেশিরভাগ মানুষ আইফেল টাওয়ারের সামনে হামলে পড়ে! কিন্তু রিপন ভাই মনে করেন, এর চেয়েও অনেক দর্শনীয় ব্যাপার-স্যাপার আছে প্যারিসে! এর মধ্যে অন্যতম মোমের জাদুঘর গ্রেভা মিউজিয়াম। প্যারিসে এসে এখানে না গেলে নাকি ভ্রমণটাই বৃথা!

কৌতূহল বেড়ে যাওয়ায় পরদিন সকাল ১১টার মধ্যে হাজির হলাম প্যারিসের প্রাণকেন্দ্রে গ্র্যান্ড বুলভার্দে সেইন নামক স্থানের ডানদিকে ১০ বুলভার্দ মোমার্তে অবস্থিত গ্রেভা মিউজিয়ামে। এখানে আসতে ৮ ও ৯ নম্বর মেট্রো ধরতে হয়। বাসের ক্ষেত্রে ওঠার সময় ২০, ৩৯, ৪৮, ৬৭, ৭৪ ও ৮৫ নম্বর কি-না খেয়াল রাখতে হবে। জাদুঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা কর্মীরা স্বাগত জানিয়ে লালগালিচায় হেঁটে ভেতরে ঢোকার পথ দেখিয়ে দিলেন। জাদুঘরে টিকিট কাটার জন্য সারি বেঁধে দাঁড়াতে হয়। দাঁড়িয়ে থাকা দর্শনার্থীদের দিকে তাকিয়ে থাকেন জার্মান তাত্ত্বিক পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন! মুখের সামনে আঙুল এনে কি যেন ভাবছেন তিনি। এটা আইনস্টাইনের মোমের মূর্তি। এর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার পর টিকিট কাউন্টারের ওপর মূল্যতালিকা দেখছিলাম মনোযোগী ছাত্রের মতো। সঙ্গে রনি ও আরেক প্যারিস প্রবাসী তরুণ মামুন আবীর। মোমের জাদুঘরে ঢুকতে চাইলে গুনতে হয় ২৩.৫০ ইউরো। ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের জন্য নির্ধারিত টিকিটের মূল্য ১৬.৫০ ইউরো। ছয় বছরের নিচে শিশুদের প্রবেশ উন্মুক্ত। সোম থেকে শুক্রবার প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘর। শনি, রবি, ছুটির দিন ও স্কুল ছুটির সময় সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত দর্শনার্থীরা আসতে পারেন এখানে। ছাড়ের ব্যবস্থাও আছে। প্রাপ্তবয়স্করা তিন শিশু বা তারও বেশি সদস্য নিয়ে এলে এবং ছাত্র, বেকার ও বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য মাথাপিছু ২০.৫০ ইউরো। শিশুদের বেলায় ছাড়ের পর গুনতে হবে ১৩.৫০ ইউরো।
 
টিকিট কাটার পর ছোট সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার পর দু’পাশে দুই নারী মূর্তি চোখে পড়লো। তাদেরকে পেরিয়ে যেতে হয় গুটগুটে এক অন্ধকার কামরায়। এর নাম ‘হল অব মিররস’। ঢোকা আর এই ঘর থেকে বের হওয়ার দরজায় মিটিমিটি আলো দেখা যায়। চাইলে এ কামরা এড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়। কয়েক মুহূর্ত পর ঘোষণা এলো, শো শুরু হতে যাচ্ছে। ফলে কৌতূহল তৈরি হলো। আয়নামহল দেখার লোভ সামলানো গেলো না। ধীরে ধীরে নানান রঙের আলো জ্বলে উঠতে লাগলো, বাজছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রিত সুর। চারদিকে কাচঘেরা নানান প্রাচীন ও পৌরাণিক শিল্পকর্ম। এখানে আসা দর্শনার্থীদের এভাবেই স্বাগত জানানো হয়। এই আয়নাঘর তৈরি হয়েছে ১৯০০ সালে। মাঝে কয়েক বছর বন্ধ ছিলো। সংস্কারের পর এটি আবার চালু করা হয় ২০০৬ সালের এপ্রিলে। মনে হলো, মোমের জাদুঘরে বেড়ানোর শুরুটা এমন চিত্তাকর্ষক হওয়াই তো বাঞ্ছনীয়। আর অপেক্ষা করলাম না। ঢুকে পড়লাম। শুরুতেই দেখলাম স্প্যানিশ অভিনেত্রী পেনেলোপি ক্রুজকে। এ কি! জ্যান্ত পেনেলোপিই যেন সামনে! গায়ে ঝলমলে নীল পোশাক। কানে লম্বা দুল। মোমের কি নিখুঁত কাজ। পেনেলোপির দিক থেকে ঘুরে তাকাতেই দেখি ফরাসি সুপার মডেল লেটিসিয়া ক্যাস্তার মূর্তি। তার পাশে ভারতীয় জাদুকর পিসি সরকারের একটি আলোকচিত্র। এরপর আরেকটি আঁধার জায়গা। সেখানে পা রাখতেই ক্যামেরার ঝলক চলতে থাকলো। মনে হলো বেশ কয়েকজন আলোকচিত্রী আমার ছবি তুলছেন! আসলে এটাও এখানকার কেরামতি। কারও উপস্থিতি টের পেলেই বিশেষ ব্যবস্থায় ক্যামেরার শাটার পড়ার মতো আলো জ্বলতে থাকে। আলোতে দেখা যায় এক বয়স্ক লোক হাতে বেশকিছু কাগজ নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছেন! এটাও মূর্তি। এই ঘরটা পেরোলেই গ্রেভা থিয়েটার। এখানকার সব চেয়ার লাল। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম ইতালিয়ান অভিনেতা-নির্মাতা নিচে চেয়ে তুমুল হাসছেন! গুটি গুটি পায়ে এগোতে এগোতে মনে হলো- বন্ধু, পরিবার-পরিজন নিয়ে এলে সত্যিকার অর্থেই স্মরণীয় কিছু মুহূর্ত কাটবে এখানে। পৃথিবী নামক গ্রহের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষদের ক্লোনের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি ও সেলফি তোলার সুযোগ কেইবা হাতছাড়া করতে চায়! শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার জন্য উপভোগ্য একটি স্থান। শিশুদের জন্য রয়েছে বিখ্যাত কার্টুন চরিত্রগুলোর মোমের মূর্তি।  

গ্রেভা মিউজিয়াম শুধু ফ্রান্সের নয়, গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন মোমের জাদুঘরগুলোর মধ্যে অন্যতম। লে গুলুয়ঁস পত্রিকার সাংবাদিক আর্থার মেয়ার জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৮২ সালে। এর প্রথম শিল্প নির্দেশক ও ক্যারিকেচারিস্ট আলফ্রেড গ্রেভার (১৮২৭-১৮৯২) নামে জাদুঘরের নামকরণ হয়। গ্রেভা মিউজিয়ামে বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র তারকা, ক্রীড়াবিদ ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বদের মূর্তিই দর্শনার্থীদের কাছে মূল আকর্ষণ। একসময়ের ও এখনকার বিখ্যাত সাড়ে ৪০০ জন ফরাসি ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের মোমের মূর্তি রয়েছে এখানে। এখানে এলে ফরাসি ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে যায়। নেপোলিয়ন থেকে শুরু করে রাজা লুই, রাজা হেনরিসহ ফরাসি বিপ্লবের রক্তাক্ত মুহূর্ত এবং ফ্রান্সের এই সময়ের আধুনিক জীবনযাপনের চিত্রও রয়েছে। সবই মোমের শিল্প। এগুলো তৈরিতে নির্বাচিত ঘটনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আসবাব আর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসও ব্যবহার করেছেন শিল্পীরা। যেমন ১৭৯৩ সালে জ্যঁ-পল মাহাতকে যে বাথটাবে হত্যা করা হয় সেটা দেখলাম। এটি গ্রেভায় নিয়ে আসা হয় ১৮৮৬ সালে। পরিপাটী কিচেনও আছে একটা। এখানে বাবুর্চি, রাঁধুনি ও রন্ধন বিশেষজ্ঞরা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন এদিক-ওদিক। কারও সামনে থালাবাসন, একজনের হাতে আছে ছোট আকারের গোল বাসন, কারও হাতে আবার শ্যাম্পেনের বোতল। একজন ওয়েটারের হাত থেকে ট্রে পড়ে যাচ্ছে এমন মুহূর্তও তৈরি করা হয়েছে মোম দিয়ে। সাজঘরে আয়নার সামনে কানাডিয়ান অভিনেতা ডোনাল্ড সাদারল্যান্ডের পাশে বসলাম। আয়নার সঙ্গে যুক্ত বাতিগুলো জ্বলছে। জাদুঘর জুড়ে সবকিছুতেই সত্যি জীবনকে যতোটা সম্ভব বিশ্বাসযোগ্য করানোর ছাপ স্পষ্ট। ফরাসি অভিনেতা জেহা দেপারদ্যু ও জ্যঁ রেনোর পাশে বসার সুযোগও হাতছাড়া করলাম না! এরপর কথাশিল্পী আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে দেখলাম উঁচু একটা চেয়ারে বসে পান করছেন! একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন ইন্ডিয়ানা জোন্সের সাজে হলিউডের বর্ষীয়ান অভিনেতা হ্যারিসন ফোর্ড। কাছাকাছি আছেন কুংফু তারকা জ্যাকি চ্যান।  

বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের মোমের মূর্তিগুলোও মুগ্ধ হওয়ার মতো। সালভাদর দালি, পাবলো পিকাসো, এমন অনেকে আছেন। শিল্পকর্ম পন্ডিতদের পেরিয়ে যে ঘরটা আছে তাতে সবাই রাজনীতিবিদ। মহাত্মা গান্ধী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ফ্রান্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, রানী এলিজাবেথ, পোপ দ্বিতীয় জন পল পরিপাটী পোশাকে আছেন। পৃথিবীর শক্তিশালী রাজনীতিবিদদের দেখে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হলো। সেখানে একের পর এক দেখা হতে লাগলো বিখ্যাত কয়েকজন সংগীতশিল্পীর সঙ্গে। জিমি হেনড্রিক্স চোখ বুজে আপনমনে গিটার বাজাচ্ছেন! স্যার এলটন জন ও রে চার্লসের মূর্তির সামনে আছে পিয়ানো। এলটনের পিয়ানোর ওপর মাইক্রোফোন হাতে বসে আছেন ফরাসি অভিনেত্রী-গায়িকা নলওয়েন লেরয়। ফিল কলিন্স বাজাচ্ছেন ড্রামস। আছেন পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসন ও পপসম্রাজ্ঞী ম্যাডোনা। খেলোয়াড়দের মধ্যে পেলে, ইব্রাহিমোভিচসহ কয়েকজনের মূর্তি দেখলাম।
এবার এলাম বিশাল এক ঘরে। এর নাম ‘হল অব কলামস’। এখানটার দেয়ালসহ সাজসজ্জা নয়নাভিরাম। গোটা জাদুঘরের মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন লাগলো এই মিলনায়তনকে। শুরুতেই আছে ফ্যাশন দুনিয়ার নামি মানুষদের মূর্তি। মডেল-গায়িকা কারা ডেলেভিন আবেদনময়ী পোশাকে এক পা তুলে চিবুকে হাত রেখে তাকিয়ে আছেন। তার কাছাকাছি সুপার মডেল নাওমি ক্যাম্পবেল। অন্যপাশে ফ্যাশন ডিজাইনার জ্যঁ-পল গলতিয়ার। নাওমির পেছনে হালের সেনসেশন গায়িকা লেডি গাগা। এই মূর্তি দেখে বেরোলেই চোখে পড়ে হলিউডের হেভিওয়েট কাপল ব্র্যাড পিট ও অ্যাঞ্জেলিনা জোলির পৃথক মোমের মূর্তি। ইতালিয়ান রূপবতী মনিকা বেলুচ্চিও আছেন! তাকে রেখে কয়েক কদম এগোতেই পেলাম চার্লি চ্যাপলিনকে! মূর্তিটির পাশে টুপি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। একটু লম্বা হলে ওই টুপিতে মাথা রেখে ছবি তোলা যায়। তার কাছ মুখ ঘোরাতেই দেখলাম হলিউড অভিনেতা জর্জ ক্লুনি শ্যাম্পেনসহ গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে এক চিলতে হাসি। ঠিক বিপরীত পাশে তার দিকে চেয়ে আছেন ‘টাইটানিক’ গায়িকা সেলিন ডিওন। সঙ্গে তার স্বামী। একটু পাশে হলিউড অভিনেতা নিকোলাস কেজ। কিংবদন্তি নির্মাতা আলফ্রেড হিচককও আছেন। ফরাসি অভিনেতা ল্যাম্বার্ট উইলসনের মূর্তিও আছে। কে নেই এখানে! কোনটা ফেলে কাকে দেখি! সমাধান দিলেন বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খান! এখানে এশীয় একমাত্র তারকা তিনিই। চেনা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। যেন সত্যি সত্যি কিং খান! ঘুরেফিরে তাকেই বারবার দেখছিলাম।  

হল অব কলামস থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে চমকে গেলাম! এতোক্ষণ যাদের দেখে সত্যি সত্যি লাগছিলো, তাদেরকে বানানোর রহস্য আছে এখানে। এই জায়গাটার নাম ‘দ্য রুট ডিসকভারি’। কীভাবে মোমের মূর্তিগুলো তৈরি হয়েছে সেই ফর্মুলা পেলাম এখানে। চারটি ধাপে এগুলো তৈরির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ভাস্কর্য, নকশা প্রণালী, চুল ও সাজসজ্জা এবং সবশেষে পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রী। কখন যে পাঁচ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে খেয়ালই নেই। এই দীর্ঘ সময় ধরে একটা ভবনেই ঘুরপাক খাচ্ছি। এ এক মধুর ঘোর! মোমের জাদুঘরটা যেন এক স্বপ্নজাল। যতো এগোবেন ততোই এই জালে জড়াবেন। যুক্তি নয়, নিজের চোখকেই বিশ্বাসস করতে ইচ্ছে হয় এখানে। না ছোঁয়া পর্যন্ত মোমের মূর্তিগুলো তো সত্যি সত্যিই আপনার-আমার কাছে তারকা! 
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৬
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ