ব্যাংকক থেকে: বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মানুষের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল থাকলেও কেবল যোগাযোগের অভাবে এতো বছরেও সম্পর্কের গভীরতায় পৌঁছাতে পারেনি দু’দেশ। তবে এই গভীরতা আনতে অনেক দিন ধরেই কূটনৈতিক চেষ্টা চলছে।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের কুইন সিরিকিত ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে চলমান তিন দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট এক্সপো-২০১৬’ দু’দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই আলোচনার সেতু হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দিনের আলোচনায় দু’পক্ষ দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিস্তর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে একমত প্রকাশ করেছেন। আর এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন তারা। একইসঙ্গে সামনের দিনগুলোতে পারস্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয়ও শোনা গেছে দু’দেশের মন্ত্রীদের মুখে। যা থেকে সম্পর্কের নতুন দিগন্তের সূচনার পূর্বাভাস পাওয়াই যায়।
এ বিষয়ে থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও এ আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা সাঈদা মুনা তাসনিম বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়ে দুই দেশের মন্ত্রীই একমত হয়েছেন। তারা মনে করেন, দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পাওয়া উচিত।
মুনা বলেন, আলোচনার জন্য মূলত আমরা দু’দেশের রাজনৈতিক নেতাদের প্যানেল তৈরি করেছিলাম। এটা আগে কখনো হয়নি। এটা অভূতপূর্ব। আমি চেয়েছিলাম, তারা (থাই মন্ত্রীরা) বাংলাদেশের কথা বলুক, তাদের মুখ থেকে বাংলাদেশের প্রতি কমিটমেন্টটা বের হোক। সেটা বের হয়েছে। প্রত্যেক থাই মন্ত্রী সেটা বলেছেন। তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে স্টাডি করেই এখানে আলোচনায় এসেছেন। তাছাড়া আমাদের মন্ত্রীদের সঙ্গে থাই মন্ত্রীদের সেভাবে দেখা-সাক্ষাৎ না হওয়ায় এমন খোলামেলা আলোচনার সুযোগও হয় না। যা এখানে হয়েছে।
সোমবার (৩০ মে) শুরু হওয়া এ এক্সপো’র প্রথম দিনে একাধিক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ভাগের আলোচনায় বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং থাইল্যান্ডের বাণিজ্যমন্ত্রী আপিরাদি তানত্রাপোর্ন দু’দেশের বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে একমত পোষণ করেন। বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্য থাই বাজারে প্রবেশের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চান তোফায়েল আহমেদ।
বর্তমানে প্রায় ছয় হাজার বাংলাদেশি পণ্যে থাইল্যান্ড শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিলেও তার বেশিরভাগই রপ্তানি অযোগ্য পণ্য হওয়ায় এ থেকে খুব বেশি সুবিধা পায় না ঢাকা।
থাই ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহবান জানিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিদেশিদের বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ উৎকৃষ্ট গন্তব্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বলে ব্যবসায়ীদের লাভবান হওয়ার সুযোগ বেশি। বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিরাপদ উল্লেখ করে তিনি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা তুলে ধরেন।
দিনের দ্বিতীয় ভাগে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের যোগাযোগ বৃদ্ধি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের প্যানেল আলোচনা শুরু হয়।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ছাড়াও এতে অংশ নেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, ডাক ও টেলি যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, থাই শিল্পমন্ত্রী ড. আটচাকা শিবুনরুয়াং, তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. পানসাক শিরিরুচাটাপুং, ফেডারেশন অব থাই ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি চেন নামচাইশিরি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাইদা মুনা তাসনিমসহ অন্যান্যরা।
আলোচনায় থাই সরকার এবং ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এখন পশ্চিমের (বাংলাদেশের অবস্থান থাইল্যান্ডের পশ্চিমে) দিকে তাকানোর সময় এসেছে। এটাই সুবর্ণ সুযোগ। থাইল্যান্ড পূর্বদিকের দেশগুলোর দিকে এগিয়েই রয়েছে। বাংলাদেশেরও এ সুযোগ নেওয়া উচিত। আর সেটা থাইল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে সম্ভব।
বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের বর্তমান অবস্থা ব্যাখ্যা করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সেইসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তিখাতও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে বর্তমানে প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথ রফতানি করছে। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশ আরও ব্যান্ডউইথ বরাদ্দ পাচ্ছে। সে সময়েও আন্তর্জাতিক বাজারে অতিরিক্ত থাকা ব্যান্ডউইথ রফতানি করবে বাংলাদেশ। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলো এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। আমরা আমাদের দরজা উন্মুক্ত করেছি। এখন থাইল্যান্ডকেও এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের গ্যাস ও তেল খাতে বিপুল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে থাই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির ন্যাশনাল রিফর্ম স্টেয়ারিং অ্যাসেমবলির চেয়ারম্যান কুরুজিত নাকোরথাপ বলেন, এখন আমাদের পশ্চিমে তাকানোর সময় এসেছে। আমরা বাংলাদেশকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত প্রসারে সহযোগিতা করতে পারি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশের মাস্টার প্লান অনুযায়ী জ্বালানিখাতে আগামী দিনগুলোতে আমাদের প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ দরকার। আর থাইল্যান্ড বাংলাদেশকে এলপিজি খাতে সহযোগিতা করতে পারে।
এর আগে, সকালে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে থাইল্যান্ডে-বাংলাদেশের প্রথম এ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ মেলা শুরু হয়।
থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের যৌথ আয়োজনে শুরু হওয়া এ মেলায় সিরামিক, পাট, পর্যটন, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, গ্লাস এবং অ্যালমুনিয়াম, টেলিকমিউনিকেশন, চা, সিল্ক, হাতে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের পসরা নিয়ে ৫৫টি স্টল দিয়েছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।
প্যানেল আলোচনা, দু’দেশের ব্যবসায়ী পর্যায়ের বৈঠক, ফ্যাশন শো ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে মেলার প্রথম দিন শেষ হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০২৪৮ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৬
জেপি/এইচএ/
** আমন্ত্রণের অপেক্ষা
**নতুন সম্ভাবনার আশায় শুরু বাংলাদেশ এক্সপো
**থাই বিনিয়োগকারীদের অন্যতম গন্তব্য বাংলাদেশ
**৪৪ বছরে প্রথম!
**‘শার্ট টু শিপ’ রফতানির জগতে থাইল্যান্ডকে আহ্বান