ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

রুদ্রসাগরের জলপ্রাসাদে

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৬
রুদ্রসাগরের জলপ্রাসাদে

মেলাঘর (ত্রিপুরা) থেকে ফিরে: বিশাল জলাশয়ের মধ্যিখানে রাজপ্রাসাদ। চোখ জুড়ানো রূপ তার।

নির্মাণশৈলীতে মুঘল আর হিন্দু স্থাপত্যের মিশেল। পাড় থেকে এর বিশালতা ঠাহর করা যাচ্ছিলো না ঠিক। আশ্বিন মাসের কড়া রোদে পুড়তে থাকা নিস্তরঙ্গ জল বেয়ে নৌকা যতো এগুতে থাকে, ততো মেলতে থাকে জল প্রাসাদের রূপ।
 
ঘাটে নেমে তো রীতিমতো বাকরুদ্ধ হওয়ার যোগাড়। প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে মূল মহলে উঠতেই গাছ-গাছালির ছায়াঘেরা ফুলবাগান। চারিপাশে বাঁধানো পথ। জল ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেওয়ালে ঝুল বারান্দা।


 
মূল ভবনে প্রথমেই দর্শনার্থী কক্ষ। তারপর শয়নকক্ষ। মাঝখানের গোলঘর ঘিরে শয়নকক্ষ ছাড়াও নাচঘর, খাব‍ার ঘর, খেলাঘর, বিচার কক্ষ। এক ঘরে ঢুকলেই প্রতিটি ঘরে ঢুঁ মারা যাবে অনায়াসে। প্রতিটি ঘরের সঙ্গেই পানির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ঝুল বারান্দা। খিলানাকার খোলা দরোজায় হুহু বাতাসের পরশ।

এই কক্ষ গুচ্ছ পেরিয়ে আর একটি উঠোন। সবুজে সবুজে বাহারি ফুলে ছাওয়া। পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতেই আরো বিস্ময়। ছাদের লেভেল সমান নয়। একেকটি উপ-ভবন বা ঘর গুচ্ছের উপরিতল একেক উচ্চতার। দুই পাশে দু’টি উন্মুক্ত গোলঘর। রাজা-রাণী এখানে হাওয়া খেতেন বলেই বোধহয় এর নাম রাখা হয়েছে হাওয়া-ভবন।


 
পশ্চিম আকাশে সূর্যটা এরই মধ্যে বিস্তেজ হয়ে এসেছে। তাকে ঘিরে মেঘের খেলা। প্রাসাদের ছাদে তবু নিস্তেজ আলোর কি এক মায়াবি লুটোপুটি। হু হু বাতাসে যেনো থেকে যেতে বলছে হাওয়া মহলই।


 
রাজার মহল আর রাণীর মহল পৃথকভাবেই চেনা যায়। পূর্ব দিকে একটু দূরে গড়া সৈন্য ব্যারাকে যাওয়া যায় মূল মহল থেকেই। উত্তরে একটু দূরে নারী-পুরুষের পৃথক শৌচাগার। সামনের চত্বরটাও নজরকাড়ার মতো সবুজ। চারিপাশের বাঁধানো চত্বরে চেনা-অচেনা গাছের সারি।


 
চারিদিকে ঘিরে রাখা ৫.৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলরাশি শান্ত হলেও কি কারণে কে জানে, নাম তার রুদ্রসাগর। আর এই প্রাসাদের নাম নীরমহল। মানে জলের প্রাসাদ।


 
রুদ্রসাগরে নৌভ্রমণ শেষে রাজা-রাণী যাতে সরাসরি মহলে ফিরতে পারেন সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে মহলের ভেতর থেকে নিচের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়িতে।    
তীর থেকে এই মহলে আসতে মিনিট দশেক সময় নেয় ইঞ্জিন নৌকা। বৈঠা বাইলে সময় লাগে দ্বিগুণ।

আনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্যশৈলীর এ মহল তৈরি করেন মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর। মুঘল স্থাপত্য রীতিতে ভীষণভাবে প্রভাবিত এই ত্রিপুরা রাজ প্রাসাদটি তৈরির দায়িত্ব দেন ইংল্যান্ডের মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানিকে। তারা ১৯৩০ সালে শুরু করে আট বছরে এ প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শেষ করেন ১৯৩৮ সালে। ভারতেরই আরেক প্রদেশ রাজস্থানের উদয়পুরে ঠিক একই রকম একটি প্রাসাদ আছে বটে, তবে সেটার চারপাশ ঘিরে রাখা জলরাশির চেয়ে নাকি ঢের বড় এখানকার রুদ্রসাগর।


 
মহারাজা বীর বীক্রম গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন ‍অবকাশ যাপনের জন্য এ মহল নির্মাণ করলেও বেশী দিন এখানে থাকা হয়নি তার। নিয়তির নির্মম পরিহাসে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি। সাকুল্যে বছর সাতেক এই প্রাসাদে বসবাসের সুযোগ পান মহারাজা।
 
মহারাজার মৃত্যুর পর বহুদিন পরিত্যক্তই পড়ে থাকে নীরমহল। ফলে কমতে থাকে এর জৌলুস। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কমতে থাকে চাকচিক্য। ১৯৭৮ সালে ত্রিপুরার তথ্য, সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নেয় নীর মহলের। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে ভবনটিতে বড় ধরনের সংস্কার করা হয়।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও নীরমহল ছেড়ে ফের ভাসতে হলো জলে। এরইমধ্যে রঙিন আলোয় নিচে হাসতে শুরু করেছে নীরমহল। রুদ্রসাগরের জলে তারই প্রতিফলন। দিনের দেখা নীরমহলের রূপটাই এবার পালটে গেছে যেনো। এমন মায়াবী মায়ার হাতছাড়ি কোথায়ইবা মেলে!
 
শীতকালে এখানে প্রায় প্রতিদিনই লাইট অ্যান্ড লেজার শো হয় এখন। এর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় এই প্রাসাদ নির্মাণের ইতিহাস, রাজপরিবারের গল্প। অতিথি পাখির আনাগোনায় সে সময় সরগরম থাকে রুদ্রসাগর। এখানে নৌকাবাইচ হয় প্রতিবছরের সেপ্টেম্বরে।
 
এই নীরমহলের অবস্থান সিপাহীজলা জেলার মেলাঘরে। রাজধানী আগরতলা থেকে এখানকার দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিলোমিটার। বাসে সময় লাগে ঘণ্টা তিনেক। ভাড়া পড়ে ৪০ রূপী। দশ রূপীর টিকিট কিনতে হয় নীরমহলে ঢুকতে। আর তীর থেকে যাত্রীবাহী ইঞ্জিন নৌকায় মহলে আসতে ভাড়া লাগে জনপ্রতি ২৫ রূপী।
 
চাইলে কাছাকাছি থাকাও যায় সাগরমহল ট্যুরিস্ট লজে। ত্রিপুরার তথ্য, সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই আবাসিকে এসি ও নন-এসি আবাসনের সুবিধা রয়েছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৯১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৬
জেডএম/
আরও পড়ুন:

**গোবিন্দের ভুবনেশ্বরীতেই রবি ঠাকুরের রাজর্ষি বিসর্জন

** ত্রিপুরা সুন্দরীর কল্যাণ সাগরে বোষ্টমী ধুঁকছে (ভিডিও)
** আগরতলায় শতবর্ষী মসজিদ, প্রাসাদের আদলে স্টেশন
** রাজ প্রাসাদ যেখানে জাদুঘর
** মাণিক্য রাজ্যের নাম কি করে ত্রিপুরা
** আড়াইশ’ টাকায় আগরতলা, ঢাকা থেকে ৪ ঘণ্টা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।