ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

চায়ের পাতায় ঢাকা পড়েছে ফারুকের শৈশব!

শরীফ সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০১৬
চায়ের পাতায় ঢাকা পড়েছে ফারুকের শৈশব! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দোকানের খেলনা দেখে শিশুরা তা নিতে গোঁ ধরবে, খেলনার জন্য মাটিতে গড়াগড়ি দেবে এটাই দেখেছি চিরকাল।

জাফলং বোল্লারঘাট (সিলেট) পিকনিক স্পট থেকে ফিরে: দোকানের খেলনা দেখে শিশুরা তা নিতে গোঁ ধরবে, খেলনার জন্য মাটিতে গড়াগড়ি দেবে এটাই দেখেছি চিরকাল। তারপর যদি সেই খেলনাটি হয় ফুটবল, তবে তো কথাই নেই।

তাই ফুটবলের পাশে দাঁড়িয়ে চা পাতা বিক্রি করার দৃশ্যটি সত্যিই বিচিত্র। চায়ের দেশ সিলেটের জাফলং বোল্লারঘাট পিকনিক স্পটে গিয়ে চোখে পড়ে এমনই করুণ দৃশ্যপট।    

আট বছরের ছোট্ট শিশু ফারুক হোসেন। তবে অভাবের তাড়না তার শিশুতোষ মনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। তাই পাশে মাথার ওপরে থাকা রঙিন ফুটবল তাকে আর খেলার মাঠে টানেনা। ডানপিটে দুরন্তু স্বভাবের শিশুটি এখন পরিবারের রোজগারে ‘অভিভাবকের’ আচরণ করছে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মায়াবী মুখায়ব আর কাব্য কথার ঝুলি দিয়ে নানাভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে জাফলংয়ের পর্যটকদের।  

আগ্রহ নিয়ে কাছে যেতেই ফারুকের কচি গলার হাঁক, ‘আসেন স্যার সিলটের চা লইয়া যান। ১ নম্বর চা। লইয়া যান স্যার; লইয়া যান। অল্প দিলেই পানিতো রঙ অইবো। একটা প্যাকেট লইয়া যান’।  

কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করতেই কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে গেলো ফারুক হোসেন। তবে চায়ের মান নিয়ে কথা বলতেই আবার চটপটে হয় সে। ঝরঝরে, কড়াপাতি, তাজা সুবাস; আরও কত কী যুক্তি দিয়ে বোঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা। মনে হলো এই বয়সেই সে যেন চায়ের মান সম্পর্কে সব কিছু বুঝে গেছে। অনুভব করলাম জীবনের প্রয়োজনই তাকে এতোটা পেশাদার আচরণ রপ্ত করতে বাধ্য করেছে।

অথচ আট বছরের এই শিশুটির মেধা শানিত করার কথা ছিল বইয়ের শব্দমালা দিয়ে। আর দশটা শিশুর মতোই খেলাধুলা ও হাসি আনন্দে মেতে থাকার কথা ছিল তার। কিন্তু স্কুলে নিয়মিত হওয়ার বদলে সে ক্রমেই নিয়মিত হচ্ছে দোকানে। পণ্য বিপণনের জন্য একজন দক্ষ হকারে পরিণত হতে চলেছে।    

স্কুলে যাওনা প্রশ্নে ফারুক জানালো, তার বাবা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিয়মিত স্কুলে যাওয়া হয়না। বাবা কামাল হোসেন পাথর ভাঙার কাজ করেন। জাফলংয়ের মোহাম্মদপুর গুচ্ছগ্রামে থাকে তারা। তার আরও দু’টি ছোট বোন আছে। তারা কাজ করতে না পারায় বাবা-ছেলে মিলে সংসার চালাতে হয়। এর ওপর বাবার সব সময় কাজ থাকেনা। অনেক সময় অর্ধাহার ও অনাহারে দিন কাটাতে হয় তাদের। অভাবের সংসারের জোয়াল টানতে গিয়ে তাই স্কুলে যাওয়া হয়না তার।  

মুক্তি স্নেক্স দোকানটি তার এক প্রতিবেশী মামার। সেখানে কাজ করে যা পায় তার পুরোটাই বাবার হাতে নিয়ে তুলে দেয় ফারুক। লেখাপড়া ও খেলাধুলায় মেতে থাকতে মন চায় তার। কিন্তু সবার তিনবেলা খাওয়া যোগাতে চা পাতা বিক্রির কাজ করতে হয় তাকে। শিশু ফারুকের ডাকে তার মুখের দিকে তাকিয়েও অনেকে চা পাতা কিনে নিয়ে যান। তাই এই পর্যটন নগরীতে অনেকেই চেনেন ফারুককে।  

পাশের দোকানের আলাউদ্দিন আলী জানালেন, জাফলংয়ের এই পর্যটন স্পটে শিশুদের দিয়ে পণ্য বিক্রি করা এখন অনেকেরই কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী এখানে আসা পর্যটকদের বাড়তি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের ব্যবসায়িক ফায়দা লুটছেন। তবে জেলা প্রশাসন এমন শিশুদের পাশে দাঁড়ালে এখানে শিশুশ্রম বন্ধ সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৬
এসএস/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।