ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

এসডিজি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে পর্যটন

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১৯
এসডিজি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে পর্যটন

ঢাকা: জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে যে ১৭টি লক্ষ্যের কথা বলেছে, তার মধ্যে ৮, ১২ ও ১৪ নম্বর সরাসরি পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকি ১৪টিতেও কোনো না কোনোভাবে পর্যটনের সংশ্লিষ্টতা আছে। তাই এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পর্যটনের বিকাশ দারুণ সহায়কের ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সেজন্য পর্যটনশিল্পের বিকাশে নানামুখী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে চলেছে বাংলাদেশ সরকার। 

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পর্যটন একটি শ্রমঘন শিল্প। এই শিল্প ১০৯টি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত হিসেবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধি আনার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে পর্যটন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির একটি দ্রুততম ও ক্রমবর্ধমান খাত হিসেবে গড়ে উঠেছে এটি। সেইসঙ্গে আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্যও স্বীকৃত হয়েছে। দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডাব্লিউটিটিসি) এর হিসাব মতে, বিশ্ব জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ১০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং কর্মসংস্থানে এ খাতের অবদান ৯ দশমিক ৯ শতাংশ (সংখ্যা ৩১৩ মিলিয়ন)। পর্যটনের এই অনস্বীকার্য অবস্থানটিই কাজে লাগাতে মনোযোগী হতে হবে সরকারি-বেসরকারি সব পক্ষকে।
 
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) মোহাম্মাদ সাইফুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, অন্যান্য শিল্পসমূহের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে পর্যটনশিল্প উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। পর্যটনের সঙ্গে উন্নয়নেরও সম্পর্ক নিবিড়। তাই আমরা মনে করি, পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নিতে পারলে এসডিজি বাস্তবায়ন সহজ হবে। ’

ট্যুরিজম বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এসডিজি বাস্তবায়ন হলে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার পথে অনেকখানিই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সেজন্য ১৭টি লক্ষ্যই ধরে ধরে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর প্রতিটি লক্ষ্য পূরণে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে পর্যটন।

দারিদ্র্য নিরসন
বিশ্বের বৃহত্তম এবং দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক খাত হিসেবে পর্যটন অর্থনীতির সব পর্যায়ের উন্নতি ও প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আয় বাড়ায়। পর্যটনের টেকসই উন্নয়ন কমিউনিটি পর্যায়ে দারিদ্র্য নিরসনে ভূমিকা রাখে। পর্যটনকেন্দ্রিক উদ্যোক্তা ও ছোট ব্যবসায়ী গড়ে উঠতে এবং স্থানীয় পর্যায়ের গরিব বিশেষ করে যুব ও নারীদের ক্ষমতায়নেও ভূমিকা রাখতে পারে।
 
ক্ষুধামুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষি
পর্যটনস্থলে আগতদের খাদ্যের চাহিদা পূরণে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ও সরবরাহকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে এবং বিক্রয়ের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই কৃষি নিশ্চিত করে থাকে। কৃষি পর্যটন, কমিউনিটি-বেজড ট্যুরিজ্মের মাধ্যমে টেকসই কৃষি নির্ভরশীলতা বাড়ে। ফলে স্থানীয় সম্প্রদায়ের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
 
নিরাপদ স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে পর্যটনের অবদান স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। পর্যটনে দেশি-বিদেশি যে আয় হবে, সেটা স্বাস্থ্য ও সেবা খাতে পুনঃবিনিয়োগ করা যায়, এর মধ্যে মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি, শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা এবং রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
 
সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণ
পর্যটনের মাধ্যমে সহনশীলতা, শান্তি ও অহিংসা এবং বৈশ্বিক বিনিময় ও নাগরিকত্বের সমস্ত দিকগুলির শিক্ষার জন্য উৎসাহ দেওয়া যায়। এই খাতে সাধারণ শিক্ষিত তরুণেরা কাজের সুযোগ পেয়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে ওঠে এবং নানামুখী শিক্ষা পেতে পারে।
 
নারীর ক্ষমতায়ন
পর্যটকদের জন্য ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং হসপিটালিটি সম্পর্কিত কাজে প্রত্যক্ষ ব্যবসা ও আয়বর্ধনের সুযোগ তৈরি হয় নারীদের। হোটেলের রিসিপশনিস্টের কাজে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ফলে পর্যটনখাতের বিকাশ হলে নারীদের ক্ষমতায়নও গতিশীল হয়।
 
পানি ও স্যানিটেশন
পর্যটনের স্বার্থে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করা হলে পর্যটনস্থানের লোকজনও এ সুবিধা ভোগ করবে।
 
টেকসই জ্বালানির নিশ্চয়তা
পর্যটনকেন্দ্রিক অঞ্চলগুলোতে বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যসের বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের শঙ্কা হ্রাস করতে পারে। এ ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ফলে নগর, আঞ্চলিক ও দূরবর্তী অঞ্চলে উদ্ভাবনী এবং নতুন শক্তির ব্যবহার বাড়তে পারে।
 
কর্মসংস্থান
পর্যটন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তিগুলির মধ্যে একটি। বর্তমানে প্রতি ১১টি কর্মসংস্থানের মধ্যে অন্তত ১টি কর্মসংস্থান হয়ে থাকে পর্যটন খাতে। পর্যটন এলাকাগুলোয় স্থানীয় সংস্কৃতি ও পণ্য প্রমোট করতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে যুব ও নারীদের স্বাবলম্বী করা সম্ভব।
 
টেকসই শিল্পায়ন
পর্যটনের উন্নয়ন নির্ভর করে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অবকাঠামো উন্নয়ন ও উদ্ভাবনী পরিবেশের ওপর। টেকসই শিল্পায়ন খাত পর্যটকদের এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের অন্যান্য উৎসকে আকৃষ্ট করে।

সামাজিক বৈষম্য হ্রাস
সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করার জন্য শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে পর্যটন, যদি স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং অংশীজনরা এতে জড়িত হয়ে যায়। পর্যটনে শহরের আধুনিকায়ন এবং গ্রামীণ উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য দ্রুত দূর হতে পারে।
 
অবকাঠামোগত উন্নয়ন
অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন এবং প্রবেশ সুবিধা, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও সম্পদ সংরক্ষণ করতে বিশেষ অবদান রাখে পর্যটন। সবুজ নগরায়নে পর্যটন যে ভূমিকা রাখে, তা পর্যটক ও স্থানীয় বসবাসকারীদের টেকসই ও নিরাপদ আবাসস্থল উপহার দিতে পারে।
 
টেকসই উৎপাদন
পর্যটনের স্বার্থে শক্তি, পানি, জীববৈচিত্র্য ও খাদ্যের ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত যে উন্নয়ন হবে, সেটা নিশ্চিত করবে টেকসই উৎপাদন।

নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার
পর্যটন অঞ্চলে ধোঁয়া নির্গত কল-কারখানা নিরুৎসাহিত করে সবুজায়নের মাধ্যমে এবং পরিবহন ও বাসস্থানে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশে কার্বনের নিঃসরণ কমানো সম্ভব। তাছাড়া পর্যটন এলাকায় আইনের যথাযথ প্রযোগের মাধ্যমে পানি, বায়ু, শব্দ ও অন্যান্য পরিবেশ দূষণ রোধ করাও যাবে।
 
ব্লু –ইকোনমির সুফল লাভ
অভ্যন্তরীণ, উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক পর্যটন সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ঘিরে গড়ে ওঠে। অভ্যন্তরীণ, উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক ট্যুরিজম উন্নয়নের জন্য অবশ্যই সমন্বিত উপকূলীয় অঞ্চলের সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এই কাজে পানির নিচের বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ ও সম্পদের টেকসই ব্যবহারের মাধ্যমে ব্লু ইকোনমির সুফল লাভ করা যেতে পারে।
 
জীববৈচিত্র্যের যথাযথ সংরক্ষণ
সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্য উপভোগ করার জন্যই পর্যটকরা পর্যটন গন্তব্যে যায়। পর্যটন বিকাশের জন্য জীববৈচিত্র্যের যথাযথ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার হতে পারে স্থানীয় সম্প্রদায়ের বিকল্প জীবিকা এবং রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্র।
 
নিরাপত্তা সুশাসন
পর্যটকদের নিরাপত্তা পর্যটন বিকাশের পূর্বশর্ত। শান্তিপ্রিয় কমিউনিটি এবং নিরাপদ ভ্রমণে পর্যটকদের আগ্রহ থাকে বেশি। তাই পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সুশাসন নিশ্চিত করা হলে সেটা স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেই লাভবান করবে।
 
একত্রে কাজ করার লক্ষ্য অর্জন
দেশীয়, আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় অংশীদারদের একত্রে কাজ করে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে পর্যটন।
 
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) একটি সূত্র জানায়, এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদশের প্রায় ৭৪ লাখ ২৭ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা (৯২ হাজার ৮৪৮ কোটি ডলার) দরকার। সেজন্য গড়ে প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই আসতে হবে। যদিও দেশে বর্তমানে আসছে গড়ে ২০০ কোটি ডলার। বিদেশি সহায়তা না এলেও দেশীয় সম্পদ দিয়ে এসডিজি বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর সরকার।  

সরকার পর্যটনশিল্পের দ্রুত বিকাশে মনোযোগ দিলে এই এসডিজি বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
 
এ বিষয়ে আলাপ করলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলানিউজকে বলেন, ‘পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটলে এসডিজি বাস্তবায়ন অনেকাংশে এগিয়ে যাবে। পর্যটন ইকোনোমির বাইরের কিছু নয়। পর্যটন বিকাশে সড়ক অবকাঠামো, পানি, শিক্ষা ও স্যানিটেশনে নজর দিতে হবে। একই কাজ এসডিজির গোলে আছে। তাই বলা যায়, পর্যটনের উন্নতি করলে এসডিজির অনেক লক্ষ্য সরাসরি পূরণ হয়ে যাবে। ’

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৯
এমআইএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।