ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ফিশারি ঘাটে মাছের মেলায়

জাকারিয়া মন্ডল, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৫
ফিশারি ঘাটে মাছের মেলায় ছবি: সোহেল সরওয়ার / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফিশারিঘাট (চট্টগ্রাম) থেকে: রাত পোহানোর এখনো ঢের বাকি। চট্টগ্রাম শহর ঘুমিয়ে।

তবে পাথরঘাটার ফিশারিঘাটমুখী রাস্তাগুলো এরই মধ্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কেটে অর্ধেক করা ড্রাম আর ঝুড়ি নিয়ে ছুটছে রিকশা-ভ্যান, পিকআপ আর ট্রাক।

ইকবাল রোডে ঢোকার মুখেই নাকে এলো মাছের গন্ধ। এরই মধ্যে একটা দুটো মাছের ঝুড়ি এসেছে রাস্তায়। তবে হাতের বাঁয়ের বিশাল চত্বরে মাছের আড়তগুলো সব জেগে গেছে। রাস্তায় বরফের চাই ভেঙ্গে চলছে মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের আগাম প্রস্তুতি। একটু পরই ওই চত্বর আর গোটা রোড জুড়ে জমে উঠবে দেশের অন্যতম বৃহৎ মাছের বাজার।

দেশে একই সঙ্গে মিঠা ও নোনাপানির এমন মাছের বাজার এই একটিই। হেন মাছ নেই যা পাওয়া যায় না এই বাজারে।

বাজার পেরিয়ে নদীর তীরে আসতেই ভিমড়ি খাওয়ার যোগাড়। তীর ছুঁয়ে নদীগর্ভের ওপর গড়ে উঠেছে মেরিন ড্রাইভ রোড। এরপর আরো শ’দুয়েক মিটার নদী হাওয়া ইট বাঁধানো চত্বরে। ঘাটে বাঁধা সারি সারি ফিশিং বোট আর ট্রলার। একটার পর আর একটা। কয়েক সারি বোটের ওপাশে অনেক সরু দেখাচ্ছে কর্ণফুলীকে।

ইট বাঁধানো বিশাল চত্বরে নানা আকৃতি আর রঙের জাল বিছানো। ডানে বঙ্গোপসাগরের দিকে ফিরিঙ্গিবাজারের ওপাশে একটা একটা করে নিভতে শুরু করলো বন্দরের আলো। বোটগুলো থেকে একটা একটা করে নামতে শুরু করলো ঝাঁকাভর্তি মাছ। আর সব সামুদ্রিক মাছের সঙ্গে জাটকা ও ইলিশের পোনাও নেহায়েত কম নয়।

ঘাটে দাঁড়িয়ে উদাসীন ভঙ্গীতে চেয়ে আছেন ইদ্রিস মাঝি। নোয়াখালীর মানুষ তিনি। অপলক নয়নে নোঙর ফেলা সব ট্রলার, নাকি নদী দেখছেন বলা মুশকিল। ফিশিং ট্রলারে কেবল ইলিশ ধরেন তারা। বাংলানিউজকে বললেন, এখন কার্তিক মাস। সিজন শেষ। চার মাস আর সাগরে যাবো না।  

এ মৌসুমে কেমন মাছ পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্দ না। আসলে চাঁদের সঙ্গে মাছের সম্পর্ক। নবমী আর দশমী তিথিতে মাছ ধরা পড়ে বেশি।

ফিশিং ট্রলার আর জাহাজগুলোর ওপর বেজায় রাগ ইদ্রিস মাঝির। বললেন, ওসব বোট আর জাহাজ থেকে যে জাল ফেলা হয় তাতে মাছের পোনাও ধরা পড়ে। তাদের কারণেই উৎপাদন কমে যায় মাছের।

ইদ্রিস মাঝির কথায় সায় দিলেন নোয়াখালীর চর আলেকজান্ডারের ইসমাইল।

কিছু সময়ের মধ্যেই ব্যস্ত হয়ে উঠলো ফিশারিঘাটের ল্যান্ডিং পোর্ট। নিষিদ্ধ পটকা মাছের ঝাঁকাও দেখা গেলো ক’টা। চোখে পড়লো নোনা পানির শাপলা পাতা মাছও। সবচেয়ে বেশি আসছে পোয়া মাছ।

ইকবাল রোডে মাছের আড়তগুলো জমে উঠলো। মেঘলা আকাশ মাথায় নিয়ে এই সাত সকালেই ক্রেতা-বিক্রেতার গিজগিজে ভিড়। তিল ধারণের ঠাই নেই রাস্তার ওপরেও।

৪০ থেকে ৫০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ছাড়াও নোয়াখালী, কুমিল্লা, যশোর আর খুলনা থেকে আসা মিঠা পানির মাছেও সয়লাব বাজার।

জাকির সওদাগরের আড়তের ম্যানেজার বিজন ঘোষ জানালেন, সারা দেশে যতো প্রজাতির মাছ বিক্রি হয় সেগুলোর প্রায় সবই আসে এই বাজারে। তবে সবচেয়ে বেশি দাম সাগর থেকে ধরা দাতিনা কোরালের। ৩০ থেকে ৪০ কেজি ওজনের একটি মাছ কখনো সখনো ৪/৫ লক্ষ টাকা মণ দরেও বিকোয় এই বাজারে। একই প্রজাতির কাই কোরাল আর লাল কোরালের কদরও আছে বেশ। আছে রূপচাদা, টেকচাদা, কালাচাদা।

সামুদ্রিক মাছের মধ্যে এই বাজারে আরো আছে শাপলা পাতা মাছ, গলদা চিংড়ি, ইলিশ, লাক্ষ্যা, কেচকি, ফাইস্যা,  রাঙা চইটকা, নাগরু, মাইট্যা, ছুরি, বোম, বাইন, গুয়াকাটা, তাইল্লা, লইট্যা, বাইল্যা, হো বাইল্যা, পোয়া, গাঙ কৈ, যাত্রিক, সুরমা, চাপিলা, চেউয়া, লাল কাপিলা, কালো কাপিলা ইত্যাদি আরো অনেক প্রজাতি।

মিঠা পানির মাছের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক জলাশয়, নদী আর চাষের-রুই, কাতলা, শরপুটি, শিং, মাগুর, কৈ, সিলভার কাপ, গ্রাস কাপ, মিনার কাপ, বিগ্রেড, মৃগেল, ভেটকি, বাটা, নাইলোটিকা, বাগদা চিংড়ি, ইছা চিংড়ি, টাকি, মলা, দেশি পুটি, শরপুটি, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, আইড়, বাইন, তারাবাইন, পিয়া, কাতল, কালবাউশ, বোয়াল, চিতল, ইলিশ, বাঘাইর, বাইল্যা ইত্যাদি আরো অনেক প্রজাতি।

পাইকারি এ বাজারে মাছ কিনতে এসেছেন ইপিজেড এলাকার খুচরা ব্যবসায়ী মিন্টু হাওলাদার। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, মাছের নামের শেষ নাই। বহুৎ নাম।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বাজারে প্রায় ৮০টি আড়তে প্রতিদিন শতাধিক মেট্রিকটন মাছ বিক্রি হয়। এ বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বরফকল ও কোল্ড স্টোরেজ। এ বাজারের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের জীবিকা জড়িয়ে আছে। চট্টগ্রামে ১০ হাজার ফিশিং বোট ও কয়েকশ’ ফিশিং ট্রলারের আহরিত মাছের অধিকাংশই বিক্রি হয় এ বাজারে।

এই ফিশারিঘাটের ঐতিহ্য প্রায় ২শ’ বছরের পুরনো। ১৬ শতকের প্রথম দিকে পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরা আসে চট্টগ্রামে। ১৫৩৭ সালে শের শাহ এর আক্রমণে ভীত হয়ে সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ পর্তুগীজদের কাছে সামরিক সাহায্য চেয়ে তাদের বাণিজ্য কুঠি ও চট্টগ্রাম বন্দরের শুল্ক আদায়ের অধিকার দেন। পর্তুগিজরা এখানে আড়ত স্থাপন করেন। তাদের নামানুসারে এলাকাটি পরিচিতি পায় ফিরিঙ্গিবাজার নামে। সেই বাজারের অদূরে গড়ে ওঠে মাছ বা ফিশ এর কয়েকটি ল্যান্ডিং স্টেশন। সবচেয়ে বড় ল্যান্ডিং স্টেশনটি পরিচিতি পায় ফিসারিঘাট নামে। ঐতিহ্যের দিক থেকেও তাই এ বাজারের গুরুত্ব অনেক।

** খাদের ওপর সরু সিঁড়িতে কলজে শুকিয়ে আসে

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৫
জেডএম/ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।