[পূর্ব প্রকাশের পর]
রুংরাং থেকে এখন শুধু ডাউন হিল। ডাউন হিলের এক ধরনের মজা আছে আবার আছে ভয়ও।
এর মধ্যে কিছুটা বেলা বেড়ে গেছে। সূর্যও খানিকটা মাথার ওপরে। বসন্তদিনে আবারও চৈত্রের হানার আশঙ্কা। খনরুই জানালো সামনে কির্সতং অবধি এবং সেখান থেকে ফেরার রাস্তায় পানির উৎস নেই। এটি একটি ভয়ের ব্যাপার। তাপমাত্রা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়ছে। পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তায় পথ চলতে চলতে যেখানে তেষ্টা পায় সেখানে পানি থাকাটা জরুরি।
ট্রেকিংয়ের আরেকটি নেতিবাচক দিক আছে। অল্প সময়ের মধ্যে লক্ষ্য ছুঁয়ে যদি ফেরার তাড়া থাকে তাহলে পথের পাশের ভুবন ভোলানো সৌন্দর্যও ঠিক তাড়িয়ে উপভোগ করা যায় না। আমাদের তাড়া ছিলো। সবচেয়ে বড় কথা আজ রাতে কোথায় থাকবো তা ঠিক করা ছিলো জরুরি। কারণ তার উপর নির্ভর করবে আমাদের ফেরার রুট।
খনরুই প্রথম থেকেই কির্সতং সামিট করে তিন্দুর দিকে নেমে যাওয়ার কথা বলছিলো। এ এলাকা অপরিচিত থাকায় আমরাও আর ওর কথার দ্বিমত করলাম না। আমরা পাহাড়ি রিজের পায়ে চলা রাস্তা ধরে অগ্রসর হচ্ছিলাম। ইতোমধ্যেই প্রচণ্ড গরমে কাহিল মোটামুটি সবাই। তার উপর পার হতে হচ্ছিলো সব ন্যাড়া পাহাড়ি পথ। তবে আশার কথা কির্সতংযের কাছাকাছি পথটুকু ঘন বনে ঢাকা।
ট্রেক করতে করতে আমাদের ট্রেইল ঢুকে গেলো ঘন বনের ভেতর। তবে এখানে এসে মন খারাপ হয়ে গেলো। এতো দুর্গম পাহাড়েও প্রকৃতি মানুষের ছোবলে ক্ষত বিক্ষত। বিশাল বিশাল গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছে। দূরে আরও গাছ কাটার শব্দ পাওয়া গেলো। মন খরাপ করা এ দৃশ্য দেখতে দেখতে ঢুকে গেলাম চিম্বুকের ঘন বনে। সত্যিকার অর্থেই এ যেন বন। বিশাল বনষ্পতিরা এখনও ছায়া মেলে পাহারা দিচ্ছে নীচের স্তরের উদ্ভিদ-গুল্ম লতাদের।
তার আড়াল থেকে কোন ঝিঁ ঝিঁ পোকা একটানা সুর তুলেছে অলস সাইরেনের। তাদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা আমরা কয়েকজন হানাদার শুকিয়ে যাওয়া পাতা ভাঙার শব্দ তুলে হেঁটে চলেছি নিরন্তর লক্ষ্যের পানে। মাঝে বন এতো ঘন হয়ে উঠছে যে পথ বের করাটাই মুশকিল। কিন্তু খনরুই পাকা পাহাড়ি শিকারির মতোই আপন মনে হেঁটে চলেছে। যেন কত দিনের চেনা পথ ওর।
অন্যদিকে আমাদের ক্লান্তি কিন্তু চরমে পৌঁছাতে বাকি। তার উপর পানি হিসাব করে খেতে হচ্ছে। কির্সতংয়ের রিজ ধরে এগোতে মাঝে মধ্যে পড়ছে খাঁড়া চড়াই। সেসব পার হওয়া আরেক ঝক্কির কাজ। শুকনো পাতার স্তূপে পা দিলেই মাঝে মাঝে পিছলে যাচ্ছে। কোনটি আসল চূড়া এখন সেটি নিয়েই দেখা দিলো বিভ্রান্তি।
খনরুই জানালো এর আগে সে এ রাস্তায় আসেনি। একদিকে ক্লান্তি অন্যদিকে এখন পথ হারানোর দুশ্চিন্তা এসে ভর করেছে। সামনে পেছনে ডানে বায়ে এমন ঘন জঙ্গল যে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু সরু পথটুকু ধরে এগিয়ে যাওয়া। এমন সময় দূরে গাছপালার ফাঁক গলে এ রিজের শেষ মাথা দেখা গেলো।
আমরা তো ব্যাপক আশা নিয়ে আবার ছুটলাম। হায়! সেখানে পৌছে উঁকি দিয়ে দেখি আবারও একই দৃশ্য। অর্থাৎ রিজের আরও অংশ বাকি। তবে এতটুকু বুঝলাম কির্সতং চূড়া ছুঁতে হলে এ রিজের শেষ পর্যন্ত যেতে হবে। কারও মুখে আর কোনো কথা নেই। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু হাঁটছি। খানিকটা এগিয়ে যাওয়া খনরুইয়ের উল্লাস ধ্বনি কানে এলো। ইয়েসসস!! আমরা কির্স পাখির বাসায় পৌঁছে গেছি। কির্স এক ধরনের ছোট পাখি। এই পাহাড়ের খাঁড়া ঢালে বাসা বেঁধে তারা থাকে। তাদের নামেই এর নাম কির্সতং। আর তং মানে পাহাড়।
চূড়ায় পৌঁছে দেখা গেলো মাটিতে ছোট বাশের লাঠিতে জাতীয় পতাকা টাঙানো। আগের ট্রেকিং গ্রুপ টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। প্রথম পাঁচ মিনিট কারও মুখে কোনো কথা নেই। শুয়ে বসে ক্লান্তি একটু দূর করার চেষ্টা। তারপর হামলে পড়লাম খাবারের উপর। এক নিমেষে সাবাড় চকলেট আর চানাচুর। ২৯৯৭ ফুট উচ্চতার এ চূড়া থেকে অবশ্য ভালোই দিগন্ত দেখা যায়। আবার ফটোশ্যুট এবং সামিট নোট লেখা।
অন্য অনেক টিমের সামিট নোট পেয়ে বোঝা গেলো কির্সতং ট্রেকার সমাজে ভালোই জনপ্রিয়। চূড়া থেকে একেবারে খাঁড়া ঢাল নেমে গেছে। নীচে বুশিং নামে একটি পাড়া আছে। ইচ্ছে করলে এখান থেকে উইং স্যুট জাম্পও করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের তখন ফেরার চিন্তা। তারচেয়েও বড় চিন্তা এ ঘন বনের রিজ ধরে যতটুকু উঠেছি আবার ততটুকু নেমে পরিষ্কার অংশে পৌঁছানো।
চলবে...
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
এএ