ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

৪০ কিমি হেঁটে রোমাঞ্চকর তিনাপ সাইতার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৭ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৬
৪০ কিমি হেঁটে রোমাঞ্চকর তিনাপ সাইতার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ছবিটা প্রথম দেখি ফেসবুকে ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশ গ্রুপে। কেউ একজন জানতে চাচ্ছিলেন ঝরনাটা কোথায়, কিন্তু কেউ উত্তর দিতে পারছিলেন না।

অবাক না হয়ে পারলাম না। এমন নয় যে বান্দরবানের ঝরনা কখনো দেখিনি। বান্দরবানের গহীনে জাদিপাই ঝরনাটাই এ যাবতকালে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর আর প্রিয় ঝরনা ছিলো। কিন্তু এটা যেন সম্পূর্ণ আলাদা। একটু অন্যরকম।

বিশাল বিশাল বোল্ডারগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো পাহাড়ের ওই অংশটা ভেঙেচুরে পথ করে নিয়েছে ঝরনাটা। হয়তো এ কারণেই ঝরনার চারপাশে ছড়িয়ে আছে এসব বিশাল বোল্ডার। তখনই নেশা চাপলো ঝরনাটি দেখার।

ছবির কমেন্ট থেকে জানতে পারলাম, পাইন্দু সাইতার নামের এ ঝরনার অবস্থান বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে। যেতে হলে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে ৪০ কিলোমিটার পথ। আবার সেই পথেই ফিরে আসতে হবে। বম ভাষায় সাইতার শব্দের অর্থ ঝরনা। পরে অবশ্য গিয়ে জানা যায় ঝরনাটির নাম তিনাপ সাইতার।

বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। এর মধ্যেই ভ্রমণগুরু জিয়ন ভাইয়ের ইভেন্ট দেখলাম, তিনি যাচ্ছেন পাইন্দু সাইতারে (তখন আমরা এ নামটাই জানতাম)। সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমিও যাবো। বান্দরবানে ট্রেকিং করতে যাই না অনেক বছর হয়ে গেলো। এতো বছর পর আবার সেই পুরনো দিনের মতোই উত্তেজনা, কখন আসবে সেই দিন। ট্রেকিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যোগাড় করতে শুরু করলাম। কিন্তু দিন যেন আর কাটে না।

অবশেষে ১৯ মে রাতে আমরা ২৬ জনের দল রওয়ানা দিলাম ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। আরেকজন ভ্রমণগুরু নিজাম উদ্দিন ভাই ঠিক করে দিয়েছেন কোন পথে যেতে হবে। সকালে বান্দরবান শহরে পৌঁছে রোয়াংছড়ি বাসস্ট্যান্ডে এসে ছোট বাসে করে ছুটলাম রোয়াংছড়ি সদরের দিকে। ২০ কিমি পাহাড়ি রাস্তা ধরে মাত্র দেড় ঘণ্টায় চলে এলাম ছোট্ট উপজেলা শহরে।

প্রয়োজনীয় কেনাকাটা যেমন শুকনো খাবার, প্লস্টিক শিট, রেইন কোট, ওষুধ-পত্র নিয়ে শুরু করলাম হাঁটা। বেলা তখন প্রায় ১১টা। তেইশ কিলোমিটার পথ সামনে, যার মধ্যে প্রথমেই আছে ঝিরিপথ। ঝিরিপথটা ভালোই লাগছিলো। একটাই সমস্যা হলো বর্ষার কারণে পানি ঘোলা। এতে ক ডুবো পাথরগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। এদিকে বৃষ্টিও পড়ছে। সাবধানে দেখে-শুনে পথ চলতে হচ্ছে। তাতে কি রক্ষা হয়, কম-বেশি আছাড় খাচ্ছিলাম সবাই।

একসময় ঝিরিপথ থেকে বের হয়ে উঠে এলাম। এবার পাহাড়ের উপরে পথ চলা। আঁকা-বাঁকা রাস্তায় ধীরে ধীরে পুরো দল এগিয়ে চলেছে। তাড়াহুড়ো নয়, ধৈর্য আর মনোবল পৌঁছে দিতে পারবে গন্তব্যে। চারপাশে মেঘের ভেলা। একসময় মেঘ চলে এলো আমাদের পথে, যেন ঠিক করেছে আমাদের আর যেতে দেবে না। মেঘের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি, এ অনুভূতি সব কষ্ট লাঘব করে দিচ্ছিলো। বিকেল ৩টার সময় এসে পৌঁছালাম পইক্ষং পাড়ায়।

এক দোকানে দুপুরের খাবার রান্না করে ফেললেন মাহবুব ভাই। স্যুপ আর নুডলস, এটাই হচ্ছে দুপুরের খাবার। এক ঘণ্টা খাবার আর বিশ্রাম শেষে ৪টার দিকে আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। সন্ধ্যার আগেই ঢুকতে হবে রনিন পাড়ায়, পথ যে এখনো অনেক বাকি। উপরে উঠা প্রায় শেষ। কিছু মেঘ দেখলাম আমদেরও নিচে। এবার নামার পালা। পাহাড়ি ট্রেইল দিয়ে নামাটাও কঠিন পরীক্ষা। দ্রুত সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ে, চলার গতি বাড়াতে বাধ্য হলাম আমরা। পথ যেন আজ আর শেষ হবে না। অবশেষে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ৩৩ শেষ হলো এদিনের যাত্রা।

রনিন পাড়ায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে আদিবাসীদের বাড়িতে। রান্নার আয়োজনও চলছে। পানির খুব সমস্যা রনিন পাড়ায়, অনেক নিচের একটা ঝিরিতে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফিরে এলাম। দেশি মুরগী, ডাল, আর খুদে চালের ভাত। পেট ভরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম কম্বল গায়ে দিয়ে! বৃষ্টির পর পাহাড়ে রীতিমতো শীত পড়ছে। সারারাত তুমুল বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাসে মড়ার মতো ঘুমে সবাই।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো মোরগের ডাকে। ফ্রেশ হয়ে তাড়াহুড়ো করে প্রস্তুত হয়ে নিলাম মূল অভিযানের। আগের রাতের আর্মি ক্যাম্প থেকে অনুমতি মিলেছে। রোয়াংছড়ি থেকে আনা পলাশদার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন রনিন পাড়ার আরও দু’জন গাইড। মোট ২৯ জনের দলের যাত্রা শুরু করতে সময় লাগে অনেক। সকাল ৮টার দিকে বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটা দিলাম তিনাপ সাইতারের উদ্দেশ্যে।

রনিন পাড়া থেকে অল্প এগোনোর পরেই পাহাড়ে ওঠা শুরু হলো। এক পাশে বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু পর্বত সিপ্পি। হাঁটতে শুরু করার কিছুক্ষণ পরে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে, এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা পর দেবাছড়া পাড়ায় ছোট্ট বিরতি। তারপর আবার ঝিরির মধ্যে পথচলা। ঝিরি থেকে উঠে আবার পাহাড়ি রাস্তা। দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ দেখা পেলাম পাইন্দু খালের। বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বাড়ছেই। ফুলে ফেঁপে উঠেছে খাল। বড় বড় পাথরের এ মারাত্মক খাল ধরেই যেতে হবে তিনাপ সাইতারের কাছে।

গাইডরাও চিন্তিত। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে ফেরা অসম্ভব। সারারাত বৃষ্টিতে পাহাড়ের উপরে কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। তাড়াহুড়ো করেই শুরু হলো খালের মধ্যে ঝরনা দেখার অভিযান। প্রতিটি পাথরের পাশ কাটিয়ে আগে হাতের বাঁশ দিয়ে জায়গাটা দেখে পা ফেলতে হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকবার পার হতে হয়েছে খাল। এসব যায়গায় একজন আরেকজন ধরে মানব-শেকল তৈরি করে পৌঁছাতে হয়েছে। কয়েক জায়গায় দক্ষ ট্রেকার আর গাইডরা আগে উঠে পরে টেনে টেনে তুলতে হয়েছে সবাইকে।

জীবনের সবচেয়ে কঠিন এই পথচলা শেষ হলো এক সময়। সামনে অভূতপূর্ব দৃশ্য। বড় বড় পাথরের ওপাশে দেখা যাচ্ছে গর্বিত তিনাপ সাইতার। দলের সবার মুখে হাসি, এত কষ্ট সার্থক। এরকম ঝরনার ভরা যৌবন দেখার জন্য এতোটুকু কষ্ট করাই যায়। আড়াআড়ি বিশাল এ ঝরনার সামনে বেশ কয়েকটা বড়-সড় বোল্ডার পড়ে আছে। অনেক কষ্টে সেগুলোর উপর উঠলাম। কিন্তু ছবি তোলার কোন সুযোগ পাচ্ছিলাম না। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণই নেই।

খালের পানিও দ্রুত বাড়ছে। শেষে মোবাইল গেলে যাবে- এটা মাথায় রেখে দু’জনকে গামছা ধরে রাখতে বলে ঝটপট দুয়েকটা ছবি নিয়ে আবার ফিরতে শুরু করলাম। ফেরার সময় বুঝতে পারলাম পানি অনেক বেড়ে গেছে এবং বাড়ছে। যে কোনো সময় ফ্লাশ ফ্লাড শুরু হতে পারে। অবশেষে একসময় পাইন্দু খালের পাশের রাস্তায় উঠে যেতে পারলাম।

বিপদ কমলেও পুরোপুরি পিছু ছাড়েনি। যে পথে নেমেছি সে পথ ধরে এখন উঠতে হবে তো! ধীরে সুস্থে আবার ফিরে চলা। পাহাড়কে আর ভয় লাগছে না। মনে যে ঝরনা জয়ের আনন্দ! কিন্তু ঝিরি পথে ঢুকেই আনন্দে ঘাটতি পড়লো। ডুবো পাথরে পা বেঁধে চিৎপটাং। প্রায় মিনিট দশেক বসে রইলাম পানিতে। পাথরে বাড়ি লেগেছে দুই হাঁটুর নিচেই। ব্যথায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। ঝিরির ঠাণ্ডা পানিতে পা চুবিয়ে রাখাতে আস্তে আস্তে কমছিলো ব্যথা।

অবশেষে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। দলের বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে জোঁকে ধরেছে। রনিন পাড়ায় ফেরার পরে সবার জামা-কাপড় থেকে আরও কয়েক দফা জোঁক উদ্ধার হলো। রক্তে মাখা-মাখি কয়েকজনের হাত-পা। আছাড় কে কটা খেয়েছে তার কোনো হিস‍াব নেই। কিন্তু মুখে হাসি, অজানাকে জয় করার হাসি, দুর্গম তিনাপ সাইতার দেখার হাসি। রাতের খাবার দাবারের পর আবারও ঠাণ্ডার মধ্যে বেঘোরে ঘুম। পরের দিন তো ফিরতে হবে রোয়াংছড়ি।

শেষ দিনেও দুঃসংবাদ। বৃষ্টির কারণে ঝিরি পথের শর্টকাটগুলো আর ব্যবহার করা যাবে না। তার মানে আরও অন্তত দুই ঘণ্টা বেশি হাঁটতে হবে। আবার পাহাড়ি ট্রেইলে হেঁটে চলা শুরু হলো সকাল ৯টায়। আগের চেয়ে বেশি উদ্যোম থাকলেও রোয়াংছড়ি পৌঁছাতে বিকেল ৪টা বেজে গেলো। সেখানে পৌঁছে জানলাম, বৃষ্টিতে ব্রিজ ভেসে যাওয়ায় রোয়াংছড়ির সাতে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। যাইহোক একটি বাস রিজার্ভ করে খানসামা নামক জায়গায় এসে বাঁশের সাঁকো দিয়ে নদী পার হলাম। একটামাত্র চান্দের গাড়ি ছিল সেখানে। ২৬ জনের দল ওই একটা গাড়িতে উঠেই ফিরে এলাম বান্দরবান। সর্বাঙ্গে ব্যথা, কিন্তু মনে আনন্দ।


যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে হানিফ, ইউনিকসহ বেশ কয়েকটি বাস বান্দরবান যায়। বাস থেকে নেমে রোয়াংছড়ির বাসস্ট্যান্ড থেকে লোকাল বাসে যেতে হবে রোয়াংছড়ি। সেখান থেকে গাইড নিয়ে ২৩ কিমি হেঁটে যেতে হবে রনিন পাড়া। রাতে রনিন পাড়ায় থেকে পরের দিন ৪/৫ ঘণ্টা হাঁটলে পাওয়া যাবে তিনাপ সাইতার। গাইডের নাম: জেম (০১৮৭৯৫১৫০৮২/০১৫৩২৪৫৭২২০)। থাকার জায়গা রনিন পাড়ার আদিবাসীদের বাসা। গাইডই ব্যবস্থা করে দেবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।