ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪৫)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪৫) মোল্লাহাটের ভেতরের সরু রাস্তা।

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ৪৫
গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট= ৪৫.৬৭ কিমি

'একবার এক শহুরে কাকের ভিড়ে, মিশে গিয়েছিল গানের কোকিল পাখি' – কবিতার এই লাইন দুটো লেখা ছিল হাসিবের খাটের পাশের দেয়ালে। সকালে বেরোবার সময় থেকেই মাথায় ঘুরছিল লাইন দুটো।

পারভেজ কিছুদূর পথ এগিয়ে দিতে আমার সঙ্গেই বের হলো। শেষ মুহূর্তে যুক্ত হলো হাসিবও। মাঝপথে রিফাতকে তুলে নিয়ে আজকের দিনের হাঁটা শুরু করলাম চাপাইল সেতু থেকে।  

সেতু ছাড়িয়ে হাতের বামের রাস্তা নিলাম আমরা। মূলশ্রী নামক গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে পথ চলছি। সামনেই ড্রেজিংয়ের কাজ হচ্ছে। বালুতে রাস্তার চিহ্ন পর্যন্ত উধাও। ড্রেজিং করতে আসা শ্রমিকদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে বেশকিছু অস্থায়ী ঘর। কিছুদূর পাকা রাস্তার পরে গুগলম্যাপ পথ বাতলালো একেবারে নদীর ধার ঘেঁষে। পায়ে চলা একটা পথ দেখা যাচ্ছে৷ পথের অধিকাংশ ইতোমধ্যে নদীগর্ভে।

মধুমতি নদী
কিছুক্ষণ নড়াইলের মধ্য দিয়ে পথ চলে প্রবেশ করলাম বাগেরহাটের মোল্লাহাট নামক উপজেলায়। এক বাড়ির সামনে থরে থরে সাজানো প্রচুর মাটির হাঁড়ি। চলতি পথে কচুরিপানা দেখলেই পারভেজ আর রিফাত হই হই করে হাসিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। হাসিবের নাকি প্রিয় কাজ কচুরিপানা দেখা। মৌপুরা হয়ে চলে এলাম চুনখোলায়। সরু রাস্তায় হাসিবের একদম গা ঘেঁষে চলে গেলো একটা ভ্যান। ও ভ্যানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো- 'রিংটোন দেন না ক্যান?' সবাই হাসি দিতেই শুধরিয়ে বললো- 'ওই বেল আর কি!'

এই রাস্তটা পিচ করা হলেও বেশ সংকীর্ণ। আমরা চারজন পাশাপাশি হাঁটলে রাস্তায় আর কোনো জায়গাই থাকছে না। দু’পাশে কোনো বাড়িঘর নেই এ রাস্তাতে। সবার দারুণ খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে চলতি পথে কোনো বাজারই পড়েনি। মাঝে মধ্যে একটা-দুটো বিচ্ছিন্ন দোকান শুধু।

নারী মাঝি ছুটে চলছে এক মাত্র যাত্রীকে নিয়ে!ছোট্ট একটা উঁচু সেতু ডিঙিয়ে মহাসড়কে। জয়ডিহি থেকে বিদায় নিল পারভেজ আর হাসিব। আমাকে অল্প একটু এগিয়ে দিতে এসে দু’জনেই সাড়ে চৌদ্দ কিলোমিটার হেঁটেছেন। রিফাত রয়ে গেলো আরো কিছুদূর হাঁটবে বলে। এই মহাসড়কের দু’পাশে শিশু গাছ আর কড়ই গাছের রাজত্ব। নেই কোনো ধানক্ষেত কিংবা সবজি ক্ষেত। দু'পাশে বিশাল সব মাছের ঘের। দিগন্তজোড়া বিস্তৃতি ঘেরের। রিফাত কিছুদূর পরপর থেমে গিয়ে মাইলফলক তুলছে। ও নাকি বেশ কয়েকবার ফার্মগেট থেকে হেঁটে খিলগাঁও গেছিল, সেটাই বন্ধুরা বিশ্বাস করেনি। আজকেরটা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। সরকারি পুকুর নামক জায়গার পরেই চাঁদেরহাট। এই মহাসড়কে তেমন কোনো বাজারই নেই। চার-পাঁচ কিলোমিটার পরে কদাচিৎ দেখা মিলেছে বাজারের।

আরেকটু এগিয়ে হাতের ডানে কেন্দুয়া বিল। নামে কেন্দুয়া বিল হলেও মূলত মাছের ঘের। দৃষ্টি কাড়ল খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বৈঠা বেয়ে নৌকা চালানো এক নারী। তার নৌকার একমাত্র সওয়ারি অবশ্য সারমেয় গোত্রের। কেন্দুয়া ব্রিজের পরই পেলাম শামুকের গোরস্থান। খুব সম্ভবত মাছের ঘেরে জালের সঙ্গে উঠে আসে এসব শামুক। লাখ লাখ এসব শামুকের জায়গা হয়েছে রাস্তার ধারে৷ আরো শামুক পেরিয়ে ফলতিতা বাজার।  

গোরস্থান!
ফকিরহাট উপজেলার মধ্যেই পড়েছে এই বাজার৷ এই বাজারের নামের মধ্যে ফল থাকলেও এখানে শ'খানেক মাছের আড়ৎ বাদে কিছু চোখে পড়েনি। একটা পুরো বাজার শুধু মাছময়। দ্বিতীয় কোনো জিনিস নেই। রাস্তার ধারে সার বেঁধে দাঁড়ানো পিক-আপ ভ্যান। বরফ দেওয়া মাছ ককশিটের প্যাকেটে মোড়ানো অবস্থায় উঠিয়ে পাঠানো হচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে।

মূলঘর পার হয়েই ভৈরব নদী। সেতুর পরপরই একটা রাস্তা হাতের বাম দিকে গিয়েছে কাঁঠালতলা পর্যন্ত। কাঁঠালতলা স্কুলের শহীদ মিনার তৈরি টাইলস দিয়ে। যেকোনো সরকারি মনুমেন্টে টাইলসের অবাধ ব্যবহার লক্ষণীয়। এই রাস্তায় শত শত সুপারি গাছ। লিকলিকে আকাশচুম্বী এসব গাছ থেকে কীভাবে সুপারি পাড়া হয় সেটাই এক বিস্ময়। এছাড়াও আছে বেশকিছু পানের বরজ। পথ চলতে চলতে গল্প করছি রিফাতের সঙ্গে। শিল্পী এসএম সুলতান থেকে শুরু করে আরজ আলী মাতুব্বর- কেউই বাদ গেলো না। পাইক পাড়ার পরেই যাত্রাপুর। এক দোকানে লেখা দেখলাম- বাকি বিক্রি মাথায় হাত, নগদ বিক্রি পেটে ভাত। সদর উপজেলার শুরু এই যাত্রাপুর থেকেই। এই এলাকার সংসদ সদস্য অধুনা বহুল আলোচিত সুদর্শন শেখ তন্ময়।

খান জাহান আলী মাজারের ওরশ
তিনটা রাস্তা আছে এখান থেকে বাগেরহাট যাওয়ার। আমরা বেছে নিলাম মাঝের রাস্তাটা। এই রাস্তাটা বেশ সরু। এই রাস্তায় আগে ছিল রেললাইন। পরে লাইন তুলে ফেলার পরে এখন ইটের খোয়া বিছিয়ে খানিকটা চলনোপযোগী করা হয়েছে। গাছভর্তি বেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুললো রিফাত। সম্প্রতি ন্যাড়া হয়েছে ও। পুরো দিনের জার্নিতে একবারই বেলতলায় যেতে দেখলাম ওকে। সাবেকডাঙ্গা পার হয়ে ষাটগম্বুজ রেল স্টেশন।

এককালে যে এই জায়গায় স্টেশন ছিল সেটার চিহ্ন বহন করছে রাস্তার উপর থেকে যাওয়া দুটো রেল পাত। সন্ধ্যার আগে আগে পৌঁছালাম বাদামতলা মোড় হয়ে মাজারের ঘাটে। এর মধ্যেই ফোন দিলাম আমিম ভাইকে। ওনার পিছু পিছু খান জাহান আলীর মাজার লাগোয়া ওনার বাড়িতে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলেন- এই মুহূর্তে কি সবচেয়ে বেশি দরকার? আমি জানালাম অল্প একটু পানি হলেই গোসলটা সেরে নিতে পারবো। আমিম ভাই পাশের সুবিশাল দীঘি দেখিয়ে বললেন- এরকম এক দীঘি পানি হলে হবে তো? খান জাহান আলীর মাজারের আশপাশে তিল ধারণের জায়গা নেই। আজ থেকে শুরু হয়েছে বার্ষিক ওরশ। হাজারো লোকের ভিড়। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষ পাটি বিছিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ঘটের কাছে। রিফাত ছেলেটা অল্প একটু হাঁটতে এসে চলে এলো গোপালগঞ্জ থেকে বাগেরহাটে। আমি ওকে বললাম এরপর যতবারই বাগেরহাট আসবা আমার কথা মনে পড়বে। ও প্রত্যুত্তরে জানাল এই দিনটার কথা ও বাকি জীবন ভুলবে না।

আরও পড়ুন>>

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪২)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩০)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)


বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।