ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আগরতলা

মুক্তিযুদ্ধের অনালোকিত ভাষাসৈনিক ত্রিপুরার সুবিমল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬
মুক্তিযুদ্ধের অনালোকিত ভাষাসৈনিক ত্রিপুরার সুবিমল ছবি- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যারা পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে অস্ত্র হাতে করে ময়দানে লড়াই করেননি, কিন্তু বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিলেন অনেকে।

আগরতলা: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যারা পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে অস্ত্র হাতে করে ময়দানে লড়াই করেননি, কিন্তু বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিলেন অনেকে।

যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন তারা।

এ অনুপ্রেরণা প্রদানকারীদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিলেন কবি, লেখক, সাহিত্যিক, গায়কসহ বুদ্ধিজীবী।

এমনই একজন গীতিকার আগরতলার সুবিমল ভট্টাচার্য।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি লিখেছেন একাধিক গান, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাজানো হয়েছিলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও।

বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে তিনি স্মৃতি রোমন্থন করলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলির কথা।

১৯৭১ সালে সুবিমল ভট্টাচার্যের বয়স ছিলো ৩৩ বছর, তখনকার সময় সংবাদ মাধ্যম বলতে খবরের কাগজ আর রেডিও।

সেই রেডিওতে পাক হানাদার ও রাজাকার বাহিনীর দ্বারা নিরীহ তৎকালীন পূর্ববাংলার নিরীহ হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে নিরীহ বাঙালি মানুষের উপর অত্যাচারের খবর শোনা যেতো।

এ ধরনের অত্যাচারের খবর শুনে তিনি আগরতলায় বসে লিখলেন ‘বুড়িগঙ্গা নদীরে, তর বুকে আমি ডিঙ্গা কেমনেরে ভাসাই, পানি যে তোর রক্তে রাঙ্গা বৈঠা কান্দে তাই’ বলে একটি গান।   

তার কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন তিনি রেডিওতে শুনতে পান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত গায়ক আব্দুল জব্বার, সহিদুল চৌধুরী, আপেল মাহমুদ, স্বপ্না রায়সহ বেশ কয়েকজন শিল্পী আগরতলায় শিবিরে আশ্রয় নেন।

এই সব বিখ্যাত শিল্পীরা আগরতলার কর্নেল চৌমুহনী এলাকায় একটি গাড়ির ছুটো গ্যারেজে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

এই খবর পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি তাদের আশ্রয়স্থলে এসে হাজির হন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিপুরার আরও এক অক্লান্ত পরিশ্রমকারী ফটোগ্রাফার রবীন সেনগুপ্ত।

তার সহায়তায় আগরতলার আখাউড়া রোড এলাকার ত্রিপুরার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সমীর রঞ্জন বমর্ণের নির্মীয়মান পাকা বাড়িতে তাদের কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়।

তখন তারা সেখানে বসে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নতুন নতুন গান লিখতেন। পাশাপাশি তাদের থাকা খাওয়ার খরচ তোলার জন্য বাংলাদেশের শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন সুবিমল ভট্টাচার্যসহ তাদের সঙ্গী শিল্পীরা।

এই অনুষ্ঠান থেকে যা অর্থ পাওয়া যেতো তা তাদের দেওয়া হতো।

এদিকে এই সময় সুবিমল ভট্টাচার্যের ‘বুড়িগঙ্গা নদীরে, তর বুকে আমি ডিঙ্গা কেমনেরে ভাসাই, পানি যে তোর রক্তে রাঙ্গা বৈঠা কান্দে তাই’ গানটি কলকাতার খ্যাতনামা হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে রেকর্ড করা হয়। তখন ছিলো গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগ, গ্রামোফোন রেকর্ডে অন্য কিছু গানের সঙ্গে এই গানটি বের হলে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বের হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে গানটি।

এই গানের সাফল্য দেখে রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাকে আরও একটি গান লেখার অনুরোধ জানায়। তখন তিনি পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গার্থক গান লেখেন।

গানটি ছিলো এমন ‘পশ্চিম দেশের গোঁসাই কতই জানেন চাতুরী, কি চমৎকার তার বাহাদুরি’।

এরপর তিনি আব্দুল জব্বারসহ বাংলাদেশের অন্যান্য শিল্পীদের কলকাতায় পাঠিয়ে হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করে দেন।

এই সংস্থা থেকে আব্দুল জব্বারসহ বাংলাদেশের অন্যান্য শিল্পীদের তারপর মোট ২৮টি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গান রেকর্ড হয়।

তখনই চালু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, এই বেতার কেন্দ্র থেকে মূলত মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে গানসহ আলোচনা সম্প্রচার করা হতো।

এই বেতার কেন্দ্রে তার লেখা বহু গান সম্প্রচারিত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকায় সাক্ষাৎ করেন। তার হাতে এই গানের গ্রামোফোন রেকর্ড তুলে দেন সুবিমল ভট্টাচার্য।

২০১২ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আগরতলা সফরে আসেন তখন তিনি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সিডি আকারে তার হাতেও গানগুলো তুলে দেন।

অনেক মানুষের জীবনের বিনিময়ে ও অনেক মানুষের চেষ্টায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। তাই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অনেককে সম্মাননা জানানো হয়েছে।

এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা গান কবিতাসহ লেখালেখির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন তাদেরকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সৈনিক সম্মানে সম্মানিত করা হয়েছে।

‘আপনাকে কী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সম্মাননা জানানো হয়েছে’ বাংলানিউজের পক্ষ থেকে এই প্রশ্ন করা হলে সুবিমল ভট্টাচার্য মৃদু হেসে বাংলানিউজকে বলেন, ‘এই প্রশ্ন করে আপনি কিন্তু আমাকে লজ্জায় ফেলে দিলেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতের যারা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত তাদেরকে সম্মান জানানোর যখন নাম ঠিকানা নেওয়া হয়েছিলো তখন তার নামও নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত করণে সম্মাননা দেওয়ার সময় আর তাকে ডাকা হয়নি।

সান্ত্বনা এই আগরতলা স্থিত বাংলাদেশ অ্যাসিস্ট্যান্ট হাই কমিশন থেকে তাকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছে।

পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার আগরতলা সফরকালে সুবিমল ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাদাভাবে সময় দিয়ে সাক্ষাৎ করছেন। তার কাজের প্রশংসা করেছেন এটাই বড় প্রাপ্তি বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬।

এসসিএন/এএটি/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।