ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আগরতলা

ভারতের প্রবেশদ্বার হোক আগরতলা!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫০ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৭
ভারতের প্রবেশদ্বার হোক আগরতলা! উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ / ছবি: ডি এইচ বাদল

আগরতলা (ত্রিপুরা) থেকে: মাস খানেকের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফায় আগরতলা সফর। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে অনেকবার যাতায়াত হলেও বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটবর্তী এ প্রাদেশিক রাজধানীতে কেন যেনো আগে আসা হয়নি। 

বাংলানিউজের কল্যাণে প্রথম দফায় চার দিন, দ্বিতীয় দফায় দু’দিন আগরতলা শহর ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়। ছোট্ট এই প্রাদেশিক রাজধানীটি ভারতের অন্যান্য শহরের তুলনায় উন্নয়নের দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশের অনেক জেলা শহরের চেয়েও আকার-আয়তনে ছোট হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মোটামুটি বলা গেলেও পরিপাটি বলা কঠিন হবে।

উন্নয়ণে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও অনেক দিক থেকেই এগিয়ে গেছে। দু’দফার একটা বিষয় খেয়াল করলাম, শহরে কোনো ভিক্ষুক নেই। প্রথম দফায় ভেবেছিলাম, শহরে নেই গ্রামাঞ্চলে থাকতে পারে। কিন্তু এবার সিপাহীজলাসহ আরও কয়েকটি জেলা সদর ‍ঘুরলেও কোথাও ভিক্ষুক নজরে পড়েনি।

রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে অনেকের পিলে চমকে যেতে পারে। কারণ, এই রাজ্যে রয়েছে অনেক খাদ্য ঘাটতি। শিল্পায়ন নেই বললেই চলে, সম্প্রতি শিল্পায়ন মাত্র শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের মতো এই রাজ্যেও প্রধান খাবার ভাত।  

চাল উৎপাদনে ঘাটতি, মাছ উৎপাদনে ঘাটতি। আগরতলা শহরে যে মাছ স্থানীয় বলে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো মূলত বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা। ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকেও মাছ আমদানি করা হয়। অনেক পণ্যের জন্য অন্য রাজ্যের দিকে দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় ত্রিপুরাকে।

অনেকে হয়তো মনে করতে পারেন। সবদেশে সব পণ্য উৎপাদন হয় নাকি! অনেক দেশই-তো অনেক পণ্য আমদানি করে। কিন্তু আগরতলায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পণ্য আনতে অনেক বেশি খরচ পড়ে যাচ্ছে। যে কারণে কলকাতা কিংবা দিল্লির তুলনায় অনেক পণ্যের দাম চড়া।

গত জুন মাসে ত্রিপুরা ঘুরে কলকাতায় গিয়েছিলাম। সকালে আগরতলায় যে ডালিম দুশো টাকা কেজি দরে কিনেছিলাম, এরচেয়ে অনেক বেশি ভালো ডালিম মাত্র ১শ টাকা দরে পেয়েছিলাম কলকাতা নিউ মার্কেট এলাকায়।

এ রকম ভুরিভুরি নমুনা দেওয়া যাবে বাড়তি দামের। তেমন একটি রাজ্য কী করে ভিক্ষুক মুক্ত হয় পুরোপুরি, তা বিস্মিত করে। কোনো কোনো এলাকা যেখানে ভিক্ষুক মুক্ত করার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেও সফল হতে পারছে না। সেখানে ভিক্ষুকমুক্ত করার জন্য ভিক্ষা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এমনকি সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি শাস্তিমুলক অপরাধ উল্লেখ করে।  

এখানেই শেষ নয়, পুলিশি অভিযানের মাধ্যমে ভিক্ষুকদের আটক করারও নজির রয়েছে কোনো কোনো শহর বা দেশে। কিন্তু সেসব শহরের কাছে ত্রিপুরা মডেল হতে পারে। না পুলিশি অভিযান, না কোথাও সাইনবোর্ড টানাতে হয়েছে। তাহলে কী করে সম্ভব হলো এই অসাধ্য সাধন।

এ বিষয়ে ত্রিপুরা বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার পবিত্র করের সঙ্গে আলাপ হয় বাংলানিউজের।  

তিনি বলেন, আমরা রাজ্যের সব নাগরিককে একটি নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে এনেছি। গরিব পরিবারের জন্য রেশনের ব্যবস্থা রয়েছে। তারা ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে কার্ড দেখিয়ে কম দামে পণ্য কিনতে পারেন। প্রায় ২৫ লাখ মানুষ এই সহায়তায় আওতায় রয়েছে।

খানিকটা বাংলাদেশের ওএমএস’র মতো। কিন্তু বাংলাদেশের ওএমএস নিয়ে নানা রকম কালোবাজারির অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক সময় ভুয়া মাস্টাররোল করে পুরো চালান বিক্রি করে দিচ্ছেন ডিলাররা। কিন্তু ত্রিপুরায় সবার কার্ড থাকায় সেই সুযোগ একেবারেই নেই।  

গৃহহীনদের জন্য বাড়ি করে দেওয়া হচ্ছে। বয়স্কলোকদের জন্য রয়েছে বিশেষ ভাতা। বাংলাদেশেও এমন কর্মসূচি চলমান রয়েছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকার ফুটপাতে হাজার হাজার লোকের বসবাস থামানো যাচ্ছে না কেন!

এ বিষয়ে সহকর্মী নাসির উদ্দিন মন্তব্য করেন, একমুখ সোনা দিয়ে ভরানো যায়, কিন্তু দশমুখ ছাই দিয়েও ভরানো কঠিন।  

পুরো ত্রিপুরায় মাত্র ৪০ লাখ লোকের বাস। আর বাংলাদেশের রাজধানীতেই প্রায় দেড়কোটি আর সারাদেশে প্রায় সতের কোটি লোকের বাস।

ত্রিপুরার আরও অনেক কিছু গর্ব করার মতো রয়েছে। তাদের ট্রাফিক সিস্টেম অনেক সফল। প্রযুক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও, ম্যানুয়ালি সবই ঠিকঠাক চলছে। আগরতলায় এখনও ট্রাফিক পুলিশের হাতের সংকেতে চলে সবকিছু।  

তবে সেই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ট্রাফিক পুলিশের হাতে ‘স্টপ’ লেখা প্লাকার্ড দেখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকছে যানবাহনগুলো। কোনো গাড়ি কিংবা রিকশা উল্টো পথে চলছে না। রাস্তার উপর নেই অবৈধ পার্কিং। যে কারণে রাস্তাগুলো সরু হলেও তেমন একটা যানজট চোখে পড়বে না।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রদেশ ত্রিপুরা। ঢাকা থেকে মাত্র আড়াই থেকে তিন ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় এখানে। সীমান্তের কোল ঘেঁষে অবস্থিত ঐতিহাসিক শহর আগরতলা। বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে মেইন শহরে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট। আপনি চাইলে মাত্র এক হাজার টাকায় আগরতলা ঘুরে যেতে পারবেন।

বাংলাদেশের আর কোনো সীমান্ত দিয়ে এতো কম সময় এবং সহজে ভারতের কোনো রাজ্যের রাজধানীতে পৌঁছানো সম্ভব নয়। ছোট্ট এই শহরটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ অনেক ঐতিহাসিক নির্দশন রয়েছে। ইচ্ছা করলে সকালে এসে বিকেলে ঢাকায় ফিরে যাওয়া সম্ভব। অনেকেই এই পথ দিয়ে দিনে ঘুরে যাচ্ছেন।

আবার এখান থেকে ভারতের যেকোনো রাজ্যের প্লেন ভাড়া খুবই সামান্য। একটু আগেভাগে টিকেট কেটে রাখতে পারলে বাস ও ট্রেনের ভাড়ার চেয়েও কমদামে প্লেন টিকেট পাওয়া যায়। এখান থেকে দিল্লি কিংবা চেন্নাইয়ের রিটার্ন টিকেট পাওয়া যায় মাত্র সাত হাজার রুপিতে। আর কলকাতার রিটার্ন টিকেট পাওয়া যায় মাত্র চার হাজার রুপিতে।

এখানে সবেচেয়ে উপভোগ্য হচ্ছে আতিথেয়তা। এখানকার মানুষ অনেক আন্তরিক। লোক ঠকানোর প্রবণতা নেই তাদের মধ্যে। কলকাতার বাঙালিদের মতো ভাঙা হিন্দি বলেন না তারা, চর্চা করেন পুরোপুরি শুদ্ধ বাংলার।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৮ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৭
এসআই/এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।