ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আগরতলা

ভারতের বন-মানব (১): ৪৩ বছরে একাই বালুতটকে বানিয়েছেন ঘন জঙ্গল

সুদীপ চন্দ্র নাথ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২১ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০২১
ভারতের বন-মানব (১): ৪৩ বছরে একাই বালুতটকে বানিয়েছেন ঘন জঙ্গল

আগরতলা (ত্রিপুরা): ভারতের আসাম রাজ্যের একটি গ্রামে তার বসবাস। পাশেই বিশাল বালুতট।

প্রাণ সেখানে ক্ষণিকের। হোক সে সাপের মতো প্রাণী বা কোনো বৃক্ষ। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি তিনি। একাই চ্যালেঞ্জ নিলেন প্রকৃতির জন্য কিছু করার। চেষ্টায় কি না হয়! মরুভূমির মতো সেই বালুতট তার একক চেষ্টায় হয়ে উঠলো বনভূমি। তার নাম ছড়িয়ে পড়লো দেশ-বিদেশে। ঘরে এলো পদ্মশ্রীসহ অসংখ্য পুরস্কার। এখন তার পরিচিতি ভারতের ফরেস্ট ম্যান বা ভারতের বন-মানব। সম্প্রতি সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের মেক্সিকো সিটিতে আমন্ত্রণ পেয়েছেন একলাখ শিক্ষার্থীকে গাছ লাগানোর প্রশিক্ষণ দিতে যাওয়ার জন্য।

বিশ্বের অন্যতম বড় নদ-নদীগুলির মধ্যে একটি ব্রহ্মপুত্র। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদ-নদী ব-দ্বীপ মাজুলী ও যোরহাট। ভারী বৃষ্টিতে চীন ও অরুণাচল প্রদেশের পানি নেমে আসে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। নদী যখন এই পানি ধরে রাখতে পারে না তখন দুই কূল ছাপিয়ে বন্যা হয়, তলিয়ে যায় এই নদীতীরের বালুচরগুলো। পানির তোড়ে ভেসে যায় গাছপালা, এমনকী ঘাসও।  
আবার যখন পানি কমে তখন এই বালুচরগুলি দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমি বলে মনে হয়। আসাম রাজ্যের বন দপ্তরও আশা ছেড়ে দিয়েছিল। দৈত্যাকার নদের করাল গ্রাসে থাকা এই জমিতে সবুজ বন তৈরি করার চেষ্টা বৃথা। অথচ এই অস্তির নদের উন্মাদনার সাক্ষী এই রুক্ষ বালুচরকে তিলে তিলে সবুজ বানিয়ে শুধু আসামের বন দপ্তরকেই নয়, গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এক ব্যক্তি। তার নাম যাদব পায়েঙ্গ।

টানা ৪৩ বছরের কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ১ হাজার ৩শ একর মরুভূমির মতো বালুময় জমিকে তিনি ঘন সবুজ ও বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল করে তুলেছেন।  

সম্প্রতি ফোনে কথা হয় প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা ভারতের এই বন-মানবের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, ১৯৭৯ সাল। তার বয়স প্রায় ১৫ বছর। আসামের যোরহাট জেলার কুকিলামুখ গ্রামের যাদব দেখেন নদীচরের বালিতে বেশ কয়েকটি সাপ মরে পড়ে আছে। তিনি পরিবারের বড়দের কাছে জানতে চান এতগুলি সাপ একসঙ্গে কি করে মারা গেছে?

তখন তারা জানান, বন্যায় গাছপালা ভেসে যাওয়ায় তাদের আশ্রয়ও ভেসে গেছে। তাই এপ্রিল মাসের তীব্র রৌদ্রে যখন বালু আগুনের মতো গরম হয়ে ওঠে এদের মৃত্যু হয়। এই কথা শুনে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। তখন তার মনে হয় শুধু সাপ কেন অন্য প্রাণীও মারা গেছে বন্যার কারণে। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন যেমন করে হোক তার গ্রামের পাশের অরুণাসাপুরির ধু ধু বালুতে গাছ লাগাবেন।  

এজন্য তিনি বন দপ্তরের স্থানীয় অফিসে কথা বলেন। কিন্তু তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে এই বালুতে কোনোকিছু হবে না। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। একাই লেগে যান গাছ লাগানোর কাজে। যে জায়গায় সাপ মারা গিয়েছিল সেই জায়গাতেই প্রথম বাঁশ লাগান ও নিজ হাতে কলসি করে নদী থেকে পানি এনে দিতে থাকেন। এভাবে তার যত্নে বাঁশগুলি বেঁচে যায় এবং ধীরে ধীরে ঘাস ও অন্য গাছপালা জন্মে। সঙ্গে চলতে থাকে গাছ লাগানোর কাজ।  

চীন ও অরুণাচল প্রদেশের জঙ্গল থেকে যেসব বীজ নদের জলের সঙ্গে ভেসে আসতো সেগুলিও তার লাগানো গাছের মধ্যে আটকে আটকে নতুন নতুন প্রজাতির গাছের জন্ম হয়। এভাবে ধীরে ধীরে বেড়েছে বন, হয়েছে ঘন সবুজ। এসেছে বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদদের মতে তার লাগানো এই বনে ভারতে প্রায় ৮০ শতাংশ প্রজাতির পাখি রয়েছে। তাছাড়া আসামের ঐতিহ্যবাহী একশৃঙ্গী গণ্ডার, বাঘ, হরিণ, হাতি, শেয়ালসহ আরো অনেক প্রজাতির বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল এটি। তবে তার কাজে শুধু বাধা প্রাকৃতিক পরিবেশই ছিল না, যখনই ঘন সবুজ বনের রূপ নেয় এবং জীব-জন্তু আসতে শুরু করে এদের সঙ্গে চলে আসে চোরা শিকারির দলও, এরা প্রাণীদের হত্যা করে। এদের হাত থেকে বাদ যায়নি একশৃঙ্গী গণ্ডারও।  

২০১২ সালে মুম্বাইতে তাকে সাবেক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম ফরেস্ট ম্যান অব ইন্ডিয়া সম্মান দেওয়ার পর ধীরে ধীরে তিনি পরিবেশবাদী ও সরকারের নজরে আসেন। সবাই বন রক্ষার জন্য তৎপরতা বাড়ালে চোরা শিকার বন্ধ হয়।  

তার এই কাজের জন্য ভারত সরকার ২০১৫ সালে তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছে। তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রতি প্রণব মুখার্জির হাত থেকে তিনি এই সম্মান গ্রহণ করেন। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশ-বিদেশ থেকে এত সম্মাননা পেয়েছেন যেগুলি ঘরে রাখার মতো জায়গা নেই বলেও জানান তিনি।  

তাকে মানুষ এখন  ‘ভারতের বনের মানুষ’ নামেও ডাকেন এবং এই বনের নাম রাখা হয়েছে মোলাই বন।  

তার স্ত্রী বীনিতা, ছেলে সঞ্জয় ও মেয়ে মুমমুনিকে নিয়ে এখন গ্রামে সাধারণভাবে জীবনযাপন করেন। তার আয়ের উৎস দুধ বিক্রি করা। প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে ওঠেন এবং আটটার মধ্যে কাজ শেষ করে গাছ লাগানোর জন্য জঙ্গলে চলে যান। এই কাজে পরিবার কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি করেনি, বরং সহযোগিতা করেছে বলেও জানান।
 
তিনি জানান তার কাজ এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। এখনো নতুন আরো দুই হাজার একর জমিতে গাছ লাগানোর কাজ বাকি আছে। তাই তো তিনি এখনো প্রতিদিন এই এলাকায় গিয়ে গাছ লাগান।  

চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ১৬১১ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০২১
এসসিএন/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।