ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

পুরনো অবয়বে সাজছে সোমপুর বিহার

বেলাল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৬
পুরনো অবয়বে সাজছে সোমপুর বিহার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সোমপুর বৌদ্ধবিহার (নওগাঁ) থেকে ফিরে: কারিগরি নিপুন হাতের ছোঁয়ায় পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার হয়ে উঠছে আকর্ষণীয়। পুরনো অবয়বে নতুন সাজে সাজছে এই বৌদ্ধবিহার।


 
সংস্কারের মাধ্যমে বৌদ্ধবিহারকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেই পুরনো অবয়ব। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটির টাকার উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে। সাউথ এশিয়া ট্যুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় চলছে এই সংস্কার কাজ। এই প্রজেক্টের আওতায় আরো প্রায় ৮ কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও সংস্কার কাজ চলছে এই প্রাঙ্গণে।
 
সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) নওগাঁর ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার এলাকা ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
 
সরেজমিনে দেখা গেছে, বৌদ্ধবিহার এলাকায় চলছে কর্মযজ্ঞ। বৌদ্ধবিহারকে আগের অবয়বে ফিরে আনতে পুরোদমে সংস্কার কাজ চলছে। বিহারকে আরো আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পর্যটন মোটেল ও পিকনিক স্পট নির্মাণের কাজ চলছে। সঙ্গে চলছে পুরনো স্থাপত্য সংস্কার। প্রধান ফটক নির্মাণসহ এর দক্ষিণে থাকবে প্রত্নসামগ্রীর রেপ্লিকা। আর টিকেট কাউন্টার থাকবে উত্তরে। রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা।

এছাড়া পুরনো আদলে পুকুর নির্মাণ করা হয়েছে। বিহারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাঠ ও টালি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে প্রাচীন ডিজাইনে পিকনিক শেড। মসজিদ, কর্মকর্তা ও স্টাফদের জন্য কোয়ার্টার, নারী-পুরুষের জন্য আলাদা টয়লেট ও আনসার ব্যাটালিয়নের জন্য ব্যারাক নির্মাণের কাজ চলছে।
 
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নবম শতাব্দীর  দিকে কৈবত্য সামস্ত রনপতি কর্তৃক পাল সাম্রাজ্য বারবার আক্রান্ত হয়েছে।   সে সময় পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। প্রায় একই সময়ে বঙ্গাল সৈন্যরা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ও মন্দির পুড়িয়ে দিলে খ্রিস্টিয় ১২ শতকে সেন রাজাদের হস্তগত হয় এটি। সেন রাজারা ব্রাহ্ম ধর্মের সমর্থক ছিলেন।

রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ও মন্দির ক্রমে পরিত্যক্ত হয়। ফলে ভিক্ষু ও পূজারিরা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। এভাবে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ১২-১৮ শতক পর্যন্ত নির্জন ও পরিত্যক্ত থাকে।
 
বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভূমিকম্পের ফলে বিহারটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। ক্রমান্বয়ে এ ধ্বংসাবশেষে ধুলাবালি জমে বিশাল আকারের উঁচু ঢিবি বা পাহাড় আকৃতি ধারণ করে। সম্ভবত এভাবে এই স্থানের নামকরণ হয় পাহাড়পুর। ১৮০৭ ও ১৮১২ সালে ভারত ও শ্রীলঙ্কার প্রত্নতত্ত্ববিদ বুকানন, হ্যামিলটন ও ওয়েস্টম্যাক পাহাড়পুর পরিদর্শনে আসেন। তারা এসে দেখেন জঙ্গলের মতো ঢিবি বা পাহাড়।

পরে স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম ১৮৭৯ সালে পাহাড়পুর পরিদর্শনে আসেন। ১৯০৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে বৌদ্ধবিহারের ওপর খনন কাজ শুরু করেন। কিন্তু নওগাঁর জমিদার বলিহারের রাজা এতে বাধা দেন। তখন তিনি এটি প্রত্নতাত্ত্বিক আইনের অধীনে এনে খননের উদ্যোগ নেন।
 
তিনি ১৯২৩-১৯৩৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ বছর ধরে খনন কাজ চালান। এর ফলে এখানে একটি গুপ্তযুগের তাম্রশাসন (৪৭৯ সাল) খোদাইকৃত প্রস্তরলিপি ও ব্রোঞ্জ ভাঙ্কর্য, পোড়ামাটির ফলক চিত্র উৎকীর্ণযুক্ত রৌদ্রতাপে শুকানো মাটির সীল, অলঙ্কৃত ইট, বিভিন্ন ধাতব দ্রব্যাদি, রৌপ্যমুদ্রা, মাটির তৈরি বিভিন্ন পাত্রসহ প্রচুর প্রত্ন নিদর্শনের সন্ধান পান।

এই বিহারের প্রকৃত নাম সোমপুর মহাবিহার। সোম অর্থ চাঁদ আর পুর অর্থ লোকালয় অর্থাৎ সোমপুর মহাবিহার চাঁদের নগর বা নগরী হিসাবে চিহ্নিত ছিল। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার উত্তর দক্ষিণে ৯২২ ফুট, পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট। এই বিহারের উত্তর বাহুর মধ্যস্থলে প্রধান ও আকর্ষণীয় প্রবেশ পথ রয়েছে।

এই প্রধান ফটকের দুইদিকে পাহারাদার ও অপরদিকে অপেক্ষা কক্ষ রয়েছে। বিহারের উন্মুক্ত আগ্নিনায় ৪ বাহুতে ১৭৭টি ভিক্ষু কক্ষ আছে। অঙ্গনের কেন্দ্রস্থলে কেন্দ্রীয় মন্দির অবস্থিত। কেন্দ্রীয় মন্দিরের উচ্চতা ৭২ ফুট (বর্তমান)। এই কেন্দ্রীয় মন্দিরের কেন্দ্রীয় ভাগে রয়েছে একটি শূন্য গর্ত কক্ষ। এই কেন্দ্রীয় কক্ষটির চারদিকে দেওয়ালের গায়ে আড়াআড়িভাবে নতুন দেওয়াল, উপরের তৃতীয় ধাপে ৪টি কক্ষ ও মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে মন্দিরটি ক্রসের আকার নিয়েছে।

সেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা উপাসনা ও ধ্যান করতেন। অনুমান করা হয়, মন্দিরের ছাদে ছাউনির ব্যবস্থা ছিল। ছাউনি হিসাবে কাঠ ও পিলার হিসাবে পাথরের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় মন্দির ছাড়াও অন্য স্থানে বহুসংখ্যক বিনোদন স্তুপ, কেন্দ্রীয় মন্দিরের আদলে (মডেল) ছোট মন্দির কুপ, রান্না ঘর, ভোজনশালা, ছোট ছোট মন্দির ও অন্য অট্টালিকার সমাবেশ খুব চমৎকার।

বিহার প্রাঙ্গণ থেকে প্রায় ৪৯ মিটার দক্ষিণ কোণে একটি আকর্ষণীয় স্নান ঘাট রয়েছে। স্থানীয় লোকমুখে এর নাম হয় সন্ধ্যাবতী ঘাট বা স্নানঘাট। এর প্রায় ১২.২০ মিটার পশ্চিমে গন্ধেশ্বরী মন্দির। সোমপুর মহাবিহার থেকে প্রায় ৩৬৫ মিটার পূর্বে মালঞ্চা গ্রামের মাঝখানে সত্যপির ভিটা অবস্থিত।

এদিকে ১৯৮০ সালের পর সরকার এবং বিদেশি দাতাদের আর্থিক সহ‍ায়তায় একটি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা দেশি পর্যটকরা নির্ধারিত ফি দিয়ে এই জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারেন।
 
এই বৌদ্ধবিহারে বিদেশি পর্যটকদের জন্য রয়েছে গাইড। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক পর্যটকদের জন্য মান্ধাতা আমলের নির্মিত রেস্ট হাউসে ৬টি রুম আছে। যেগুলো সংস্কার করা হয়ছে।

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার জাদুঘর এর কাস্টডিয়ান মো. সাদেকুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, পুরনো অবয়ব ঠিক রেখে বৌদ্ধবিহারটি সংস্কারের কাজ চলছে। সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হলে বিহারটি তার আগের চেহারা ফিরে পাবে।  
 
বাংলাদেশ সময়: ০৩০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৬
এমবিএইচ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ