ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

কচি পাতার সবুজ আলোয় জীবন যেখানে প্রকৃতি

আসিফ আজিজ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
কচি পাতার সবুজ আলোয় জীবন যেখানে প্রকৃতি ছবি: শুভ্রনীল সাগর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মারমেইড ইকো রিসোর্ট ঘুরে: তীরে একটি ভাঙা সাম্পান জোয়ারে জলমগ্ন। পাড়জুড়ে নারিকেল গাছের সারি বাতাসে খেলছে দোল।

সঙ্গ দিচ্ছে অন্য গাছেরা। সাদা বেড কাভার, টাওয়েল রশিতে দুলছে হাওয়ার তালে। পাশেই একটি পুকুর। সেখানে মগ্ন হয়ে বসে একটি মারমেইড মূর্তি। ছনের ঘরগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গাছের ফাঁকে। মনে হয় পানির ওপর ঝুলছে। সাগর আর রেজুখালের সঙ্গমস্থল কাছেই।


এ দৃশ্য দেখতে দেখতে সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে মিনিট ১০ দশেকে কিনারে ভিড়লো বোট। ফুল-পাতার গার্লেন নিয়ে অতিথিবরণে ততক্ষণে দাঁড়িয়ে সাগররঙা টি-শার্ট পরা মারমেইড ইকো রিসোর্টের দুই কর্মী। আন্তরিক হাসিতে এগিয়ে নিয়ে সদ্য পাড়া কচি ডাব দিলেন হাতে। তৃষ্ণা নিবারণের সঙ্গে মনও তখন ফুরফুরে। রিসোর্টটির কর্ণধার আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগের সঙ্গে যাত্রা।


গ্রীষ্মেও কচি পাতার সবুজ আলোয় আলোকিত ইকো রিসোর্টটি। চারপাশে শুধু ছোটবড় ‍গাছ আর গাছ। প্রকৃতির কোথাও হস্তক্ষেপ করা হয়নি। তাদের মতো থাকতে দিয়েই ‍বাড়ানো হয়েছে সৌন্দর্য।


যেখানে প্রকৃতিকে ও প্রকৃতির চারপাশটাকে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে আমি সেবা দেবো, সেবার মাধ্যমে আমি আয় করবো। এই প্রকৃতির সৌন্দর্যটাকে আমরা সেল করি। যে প্রকৃতি এখন এখানে আছে, সেটা যেন শত বছর ধরে এখানে এভাবেই থেকে যায়। এর কারণে যেন প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না হয়। এখানে প্রকৃতি দেখার ব্যবস্থাটা এমনভাবে করা যেন প্রকৃতির এতে কোনো ক্ষতি না হয়।


ইকো রিসোর্ট নিয়ে মারমেইড ইকো ট্যুরিজমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আনিসুল হক সোহাগ যখন ‘সার্ফার ড্যুড’ বাংলোর কাঠের বারান্দায় বসে কথাগুলো বলছিলেন তখন পাশ দিয়ে বারবার শিশ দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলো দোয়েলটি। সাড়া না দেওয়ায় যেন বিরক্ত হয়ে বসেই পড়লো পুকুর পাড়ের কাঠচাঁপা গাছটিতে!


ইকো রিসোর্ট কনসেপ্ট যে কতটা সফল তা বুঝতে বাকি রইলো না। গাছপালা, পশু-পাখি, মাটি মানুষ সবই ইকো সিস্টেমের অংশ।


সোহাগ বলছিলেন, মারমেইড ইকো রিসোর্ট যখন তৈরি তখন আমরা সারিবদ্ধভাবে কটেজগুলো তৈরি করতে পারতাম। সেটা করিনি। যেখানে গাছ নেই সেই জায়গাগুলো বেছে নিয়ে ঘর করেছি। অরিজিনাল বনটা এখানে রয়ে গেছে। এখানে যে গাছগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো এখানকার নিজস্ব মাটিতে লাগানো গাছ। এরা নিজেরাই এখানে জন্মেছে। একসময় এখানে ধানখেতের মতো দেখা যেতো। এখন গাছগুলো বড় হয়ে গেছে। এখানকার একটি পোকাও ইকো সিস্টেমের অংশ আপনার আমার মতো।


কথার ফাঁকে কাচের গ্লাসে নারিকেল পাতা আর কাঠচাঁপার ডেকোরেশনে এলো আরও এক গ্লাস ডাবের পানি। পাশ দিয়ে নাম না জানা এক টিকটিকি সদৃশ সরীসৃপ ততক্ষণে চলে গেলো অবলীলায়। যেন তার বাপ দাদার ভিটে। সত্যিই তো! এখানে তাদের বিরক্ত করার কেউ নেই।


৩০টি কটেজ আছে এখানে। খুব ব্যয়বহুলও না। ছাওয়া ছন দিয়ে। ঘরগুলো কাঠের। ভিতর ছিমছাম গোছালো। নান্দনিক সব আসবাব। প্রতিটি আলাদা। গতানুগতিকতার বাইরে। ছন দিয়ে ছাওয়া দেখে ‍আধুনিক সুযোগ সুবিধার কোনোটির কমতি নেই। রয়েছে সবই। তবে উপকরণগুলো ‍আলাদা। বাথরুমে ঢুকে প্লাস্টিকের মোড়কে শ্যাম্পু পাবেন না। কাঠের পাত্রে সুন্দর করে গোছানো ছোট কাচের শিশিতে শ্যাম্প, অলিভ অয়েল ও হ্যান্ডওয়াশ। সাবানসহ সবই হারবাল।


ঘরের পাশাপাশি রয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গোসল সারার সুযোগও। খোলা আকাশের নিচে চারপাশ ঘেরা বাথরুম। বিচ থেকে এসে অনায়াসেই এখানে জুড়িয়ে নিতে পারেন শরীর।


বাংলাদেশিদের কাছে ইকো মানেই বাঁশ কাঠের গরিবি বাড়ি। তবে বিদেশিরা যখন ইকো রিসোর্ট নামটি দেখে তখন তারা এখানেই আসে।
ইকোটাই এখন আমাদের কাছে লাইফস্টাইল। আলাদা করে বলতে চাই না। মারমেইড বিচ রিসোর্টেও কিন্তু ইকোটাকে বেশ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।


শতভাগ সাসটেইনেবল ম্যাটেরিয়ালে তৈরি করা। কোনো কংক্রিট নেই। কাঠের বাংলো। ছন পাশের পাহাড়ে চাষ হয়। তারা এটা বিক্রি করে। এখানে যারা কাজ করে তারা এখানকার। লোকালরা অনেক বেনিফিটেড এতে।

চার একর জমি নিয়ে গড়া মারমেইড ইকো রিসোর্টের অতিথিরা ৪০ শতাংশই বিদেশি বলেও জানান আনিসুল হক সোহাগ।


রিসোর্টের পাশেই রেজু খাল। খালের পানি গিয়ে মিশেছে সাগরে। ভাটার সময় বিচ ধরে হাঁটতে পারেন প্রাণ খুলে। চাঁদের মতো বাঁকা সাম্পানগুলো জলধরে ভেসে যাবে বৈঠার তালে। পাশেই জেলে পাড়া। পেঁচার দ্বীপের মানুষগুলো আসলে এ পেশাতেই জড়িত বেশি। তবে এ ইকো রিসোর্ট এদের অনেকের জীবন দিয়েছে বদলে।


হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলেও ক্ষতি নেই। রিসোর্টে ফিরলেই গা এলিয়ে বসতে পারবেন বাঁশ কাঠের বেঞ্চ, কিটকট কিংবা বারান্দার কাপড়ের দোলনায়। আর বিভিন্ন ফ্রুট জুস অথবা ডাবের পানি সতেজতা এনে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ।


বসে খাওয়ার জায়গাটিও সাজানো বেশ নান্দনিকভাবে। বড় কাঠের গুঁড়িকে জ্বালানি না বানিয়ে তৈরি করে ফেলা হয়েছে বসার টেবিল। শুধু যুক্ত করা হয়েছে কাচ।


বেস্ট সি ফুডের জন্য বেশ নাম আছে মারমেইডের। চাইলে বোটে চড়ে সমুদ্রে মাছ শিকার করে সেই মাছ খাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া সার্ফিং, ইয়োগার সুযোগ রয়েছে।

ইকো রিসোর্টে অবকাশ যাপনে যাওয়া বিদেশির সংখ্যা কম নয়। ৪০ শতাংশ। ব্রিটেনের পর্যটক বেশি। খরচ কম হওয়ায় বাংলাদেশের ছাত্ররাও এখানে আসেন। বিশেষ করে যারা সার্ফিং করতে চান তারা।


তবে তুলনামূলক কম খরচে হানিমুন প্যাকেজও বেশ আকর্ষণীয়। নিরিবিলি একান্ত সময় কাটাতে জুড়ি নেই রিসোর্টটির। এখানকার ফুল-পাখিরা যোগ করবে বাড়তি সৌন্দর্য। জবা, কাঁঠচাপা, স্পাইডার লিলি, কলমি, অলকানন্দা, টগরসহ বিভিন্ন সুগন্ধী ফুল, দোয়েল, শ্যামা, বুলবুলি, টুনটুনির সঙ্গ উপভোগ্য করে তুলবে অবকাশ যাপন।

কক্সবাজার শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরের মারমেইড ইকো রিসোর্ট মারমেইড বিচ রিসোর্ট থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। বিচ রিসোর্ট থেকে চাইলে নৌকা বা স্পিডবোটেও আসা যায়।

প্রকৃতি যেখানে আপন আলোয় সাজানো সেখানে থাকতে চাইলে, একান্ত মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে চাইলে বুকিং দিয়ে যেতে পারেন। বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন: mermaidecoresort.com

**
বিশ্বের সবচেয়ে বড় কচ্ছপের ভাস্কর্য মারমেইডে
**এক্সাইটিং বিচ রাইডিং-বোটিং মারমেইডে
**ডিমের ভিতর ডিনার
**‘২২ বছর একইরকম, এ বছরটি ভিন্ন’
**পাতা যেখানে বাঁশি বাজায়, ঘুম ভাঙায় পাখির গান
** ছেঁড়া দ্বীপকে আবর্জনার ভাগাড় বানাচ্ছেন পর্যটকরা
**বিচ ঘেঁষে বিচ পার্ক, জানেন না পাশের ব্যবসায়ীরা!
**কক্সবাজার সৈকত বদলে দিতে পারে একজন কাদেরের চিন্তা
** নোনা দ্বীপে মিষ্টি পানি
** ড্যান্সিং বাসে কক্সবাজার টু টেকনাফ
** তথ্যহীন পর্যটন তথ্য কেন্দ্র!
** ডাব-তরমুজেই পকেট ফাঁকা সেন্টমার্টিনে
** মরা শামুক হাঁটে ছেঁড়া দ্বীপে!

 

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ