ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

মানুষ দেবী মানুষ দেবতা

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০১৭
মানুষ দেবী মানুষ দেবতা মুন্সীগঞ্জের মালঞ্চ নদী তীরে বনবিবির মন্দির। ছবি: মানজারুল ইসলাম

সুন্দরবন ঘুরে: ওরা কেউ স্বর্গের দূত নন। এই মর্ত্যেরই মানুষ। তবু পূজিত হন দেব-দেবী হিসেবেই। মানুষ হয়েও বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের লোকজ বিশ্বাসে ওরাই মানুষের রক্ষক, ত্রাণকর্তা।  

হোক হিন্দু, হোক মুসলিম, অথবা হোক খ্রিস্টান বা অন্য কোনো ধর্মমতের মানুষ, সুন্দরবনের সীমানা ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে বনজীবীরা নিজেদের তুলে দেন বনদেবী আর দেবতাদের হাতে। তাদের বিশ্বাসে জেগে ওঠেন বনবিবি, শাহ জঙ্গলী, গাজী, কালু, মানিক পীর, দক্ষিণ রায়রা।

কালজয়ী অনেক কাব্য আর পুঁথিরও জন্ম হয়েছে এসব লৌকিক দেব-দেবীর নাম ও গল্প থেকে। যেমন বনবিবির কাহিনী নিয়ে বনবিবির জহুরানামা, গাজীর গল্প নিয়ে গাজী কালু চম্পাবতী আর মানিক পীরের কাহিনী।  

বনজীবীদের কাছে স্বহিমায় পূজিত মানুষ দেবীর নাম বনবিবি। তিনি অরণ্যের দেবী রূপে পূজিতা। লোক বিশ্বাসে তিনি কখনো মুরগির রূপ ধারণ করেন, কখনো হন বাঘ। সুশ্রী, লাবণ্যময়ী ভক্তবৎসলা এই দেবীর কারো ওপরে কোনো আক্রোশ নেই। বনের সমস্ত সৃষ্টিতে তার মমতা মাখা। তিনি ভালোবাসেন মানুষ ও প্রকৃতিকে।

তিনি সুন্দরবনের জেলে, বাউয়ালি বা কাঠুরে আর মৌয়াল বা মধু সংগ্রহকারীদের রক্ষাকত্রী। তিনি হিন্দুর বনদুর্গা বা বনদেবীর মুসলমানি রূপ। বনজীবীদের ধারণা, বাঘ ও ভূত-প্রেতের মতো অপশক্তির ওপরে কর্তৃত্ব করেন বনবিবি। তাই গভীর মনে কাঠ, গোলপাতা, মধু ও মোম সংগ্রহ বা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে বনবিবির উদ্দেশ্যে শিরনি দেন ক্ষীর বা অন্ন। মালঞ্চ নদী তীরে খালের পাশে বনবিবি মন্দির।  ছবি: মানজারুল ইসলাম

বনজীবীদের তিনি রক্ষা করেন বাঘ ও বাঘরূপী অপশক্তি দক্ষিণ রায় বা রায়মনির হাত থেকে। এই দক্ষিণ রায়ও সুন্দরবনের একজন মানুষ দেবতা। তার মতো সুপুরুষ দেবমূর্তি সচরাচর দেখা যায় না। তার কবল থেকে বনবিবির উদ্ধার করা শিশু চরিত্র দু:খেও মণ্ডপে পূজিত হন বনবিবি আর দক্ষিণ রায়ের পাশে। প্রতি বছর জানুয়ারির মাঝামাঝিতে মূল পূজা হয় বনবিবির। স্থায়ী-অস্থায়ী ২ হাজারেরও বেশী মণ্ডপ সাজানো হয় বনের ভেতরে ও বন সংলগ্ন লোকালয়ে। কেবল পশুর নদীর পশ্চিম পাড়েই এরকম মণ্ডপ জমে ৩শ’ এর বেশী।

এসব মণ্ডপে বনবিবি আর দক্ষিণ রায় ছাড়াও থাকেন বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গলী, গাজী আউলিয়া, শিশু দু:খে, তার দুই চাচা ধনে আর মনে।

পূজাকে কেন্দ্র করে লোকজ মেলা বসে অনেক স্থানে। কুমিরের হাত থেকে রক্ষার জন্য দেওয়া হয় কালু রায়ের পূজা। দক্ষিণ রায়ের মতো এর মূর্তিও পুরোপুরি মানবীয়। তবে পোশাক পৌরাণিত দেবতার মতো। তার হাতে টাঙ্গি ও ঢাল, কোমরবন্ধে নানা অস্ত্র ঝোলানো। পীঠে তৈরি তীর-ধনুক। তার পূজায় সাজানো হয় ঝাউফুলের নৈবেদ্য। মুন্সীগঞ্জের পানখালী চুনা জেলেপাড়ার মন্দিরে বনবিবি, তার ভাই শাহ জাঙ্গুলি, গাজী পীর, কালু পীর, মানিক পীর প্রমুখ।  ছবি: মানজারুল ইসলাম

সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে ১৫ শতকের কাছাকাছি সময়ে সুন্দরবন এলাকায় দক্ষিণ রায়, বণিক ধনে ও মনে এবং গাজীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বনবিবির জহুরানামায় বলা হয়েছে, তিনি বেরাহিম নামে এক আরবদেশী’র কন্যা। বেরাহিমের স্ত্রী গুলাল বিবি সতীনের প্ররোচনায় সুন্দরবনে পরিত্যক্তা হন। সেখানে তার গর্ভে বনবিবি ও শাহ জাঙ্গুলী জন্ম নেন। আর দক্ষিণ রায় যশোরের ব্রাক্ষ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীন ভাটির দেশের রাজা। তার সাথে বনবিবির একাধিক যুদ্ধ হয়। দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়ে সন্ধি করেন।

পরবর্তীতে বনজীবীরা এদের বসিয়ে দেন দেব-দেবীর আসনে। এদের কাছ থেকে বনজীবীরা বাঘ-কুমির তথা বনের সব ভয় জয় করার সাহস পান। এই সাহসটাকে তারা কাজে লাগান প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে। বনজীবীদের কাছে যার যার ধর্মের পাশাপাশি তাই এরাও পূজার আরাধ্য।

বনজীবীদের স্মরণে আরো যার নাম থাকে তিনি গাজী পীর। যে কেউ বনে ঢোকার সময়ে বনবিবির সঙ্গে সঙ্গে গাজীরও নামের দোহাই দেন হাত জোড় করে। সুন্দরবন লাগোয়া লোকালয়ে সাদা দাড়িসহ পায়জামা-পাঞ্জাবি, কোথাও লুঙ্গি পরা মূর্তি দেখা যায়। যার ঘাড়ে থাকে গামছা। তার পূজার নিরামিষ নৈবেদ্য হলো বাতাসা, পাটালি বা আতপচালের শিরনি। বনে ঢোকা ছাড়াও পশু-পাখির কামনাতেও স্মরণ করা হয় গাজীর নাম।

গবাদি পশুর রক্ষক হিসেবে পূজিত হন মানিক পীর। মানুষের ভক্তিতে এই সুফী অধিষ্ঠিত হয়েছেন দেবতার আসনে।  পানখালী চুনা জেলেপাড়ার মন্দিরে বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়।  ছবি: মানজারুল ইসলাম

সুন্দরবনে বাঘের দেবী হিসেবে পূজিত আর একজন হলেন বনদেবী নারায়ণী। বাড়ির পাশের বনবাদাড় ও ঝোপঝাড় সংলগ্ন স্থানে এই বাড়তি মাতৃত্বের অধিকারী দেবীর থান দেখা যায়। এগুলোর অধিকাংশতেই খড়ের ছাউনি।

সুন্দরবনের আর এক লৌকিক দেবতা হলেন ভাঙ্গড় পীর। বনবিবির জহুরানামাতেও এই ভাঙ্গড় পীরের কথা পাওয়া যায়। তার আস্তানেই প্রথমে আসেন বনবিবি ও শাহ জাঙ্গুলি। তাদের সঙ্গে পূজা পান ওলাওঠা রোগ নিরাময়কারী দেবী হিসেবে পরিচিত বিবি মা। এই পরিচয়ের ৭ বোন মাটির স্তূপের প্রতীকে ও মাটির প্রতিমা মূর্তিতে পূজা পান।

এছাড়া সন্তান রক্ষক হিসেবে পাঁচু ঠাকুর ও পেঁচা-পেঁচির পূজা দিয়ে থাকেন বনজীবীরা।   বাসস্থান থেকে কিছু দূরে পুকুর বা খাল পাড়ের তালগাছ বা বটতলায় উন্মুক্ত স্থানে পাঁচু থাকুরের পূজার বেদি সাজানো হয়।

সুন্দরবনে আরো পূজিত হন বাদাবনের রক্ষক আটেশ্বর। কৃষিজীবী, জেলে, বনজীবীরা এই লোকদেবতাকেও যথেষ্ট ভক্তি করেন। তিন জঙ্গল সংলগ্ন স্থানে মানুষ ও গবাদি পশুর রক্ষক বলে বিশ্বাস প্রচলিত আছে।

এদের বাইরে জ্বরনাশক হিসেবে পূজিত হন জ্বরাসুর। তার বিচিত্র শরীরের রঙ নীল। ৩টি মাথা, ৯টি চোখ, ৬টি হাত, ৩টি পা। শীতলার থানে নিত্য পূজা হয় তার।

তবে মাছের দেবতা হিসেবে পরিচিত মাকাল ঠাকুরের মূর্তি অনেকটা স্তূপের মতো। জেলেরা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে অস্থায়ী বেদি সাজিয়ে তার পূজা করেন।

লোকজ দেবতাদের পাশাপাশি পূজা পান সর্পদেবী মনসা, জঙ্গল জননী বিশালাক্ষীও। তবে সুন্দরবনের লোকজ বিশ্বাসে মানুষ দেবী আর মানুষ দেবতাদেরই দাপট।

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০১৬
জেডএম/

 

 

 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ