তবে নাটোরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই জটিল। শহরের কানাইখালি মোড়ের এক আড্ডায় বসে একে ‘ছোট শহরের বড় পলিটিকস’ বলে অভিহিত করলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড শাখার এক নেতা।
শহরের প্রাণকেন্দ্র এই কানাইখালি মোড়েই প্রেসক্লাব, মার্কেট, বাজার, সিনেমা হল- সবকিছু। আর এখানকারই চায়ের দোকানে নিয়ম করে প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে আড্ডায় বসেন স্থানীয়রা।
বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার এ রকমই এক আড্ডায় বসা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ওই সহ সভাপতি বললেন, ‘আমাদের শহরটা ছোট হলেও এখানে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি অনেক জটিল। রাজনীতি ব্যাপকভাবে সহিংস’। তার মতে, ‘উত্তরবঙ্গের আর কোনো জেলা শহরের পলিটিকস এতোটা রক্তাক্ত নয়। খুন-পাল্টা খুন-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এলাকাছাড়া করা- হুমকি ধামকি। পেশিশক্তির প্রয়োগই এখন নাটোর রাজনীতির শেষ কথা’। এই কানাইখালি মোড়ই নাটোর শহরের অনেক রক্তাক্ত অধ্যায়ের সাক্ষী বলেও জানালেন তিনি। প্রকাশ্য বন্দুকযুদ্ধে এখানে কিছুদিন আগেই ঝরেছে প্রাণ।
আড্ডার সবাই শহরের আদি বাসিন্দা। তাদের কেউ ঠিকাদার, কেউ আইনজীবী, কেউ স্থানীয় ব্যবসায়ী। সবাই বন্ধু-বান্ধব। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্রব আছে কারও কারও। সারাদিনের কাজকর্ম শেষে এই চায়ের দোকানে নিয়ম করে হাজিরা দেন তারা। তবে সবারই অনুরোধ, ‘নামটা ছাপায়েন না প্লিজ’।
তাদের মতে, পুরো জেলায় বড় দুই দলের রাজনীতিতেই এখন গ্রুপিংয়ের করাল প্রভাব। আওয়ামী লীগ-বিএনপি শত্রুতার চেয়ে নিজ নিজ দলের অভ্যন্তরীণ রেষারেষিও অনেক বেশি।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চরম গ্রুপিং-পাল্টা গ্রুপিং। নিজেদের মধ্যে রেষারেষিও তীব্র। শহরের প্রত্যেক নেতা ও জনপ্রতিনিধি রাজনীতি করেন নিজের বলয়কে ঘিরে।
নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা উপজেলা নিয়ে গঠিত নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল। নাটোরের রাজনীতিতে সক্রিয় এমপি ও এমপিবিরোধী গ্রুপ।
বিরোধীদের অভিযোগ, এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে জেলার সব সেক্টরেই নিজের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শিমুল। মূলত এ আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব থেকেই তার সঙ্গে বিরোধিতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান, পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী জলি এবং জেলা যুবলীগের সভাপতি বাছিরুর রহমান খান চৌধুরী এহিয়ার।
শিমুল বিরোধী বলে পরিচিত এই নেতাদের আবার প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব গ্রুপ। কিন্তু স্বার্থের সংঘাতে যেকোনো মুহূর্তে বদলে যায় তাদের আনুগত্য ও সমর্থনের হিসাব-নিকাশও।
বিএনপির অবস্থা আরও ভয়াবহ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকজনকে একরকম ভিটা ছাড়াই করেছেন জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। দলে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে গিয়ে তিনি দলছাড়া করেছেন দলের প্রতিষ্ঠাতা জেলা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ প্রায় ১৭ জন সিনিয়র নেতাকে। ফলে বিএনপিতে এখন একক নেতা দুলু। তার বিরোধী প্রায় প্রত্যেক সিনিয়র নেতাই বহিষ্কৃত। তবে নিজেদের মতো করেই শহরে দুলু বিরোধী রাজনীতি করে যাচ্ছেন এই নেতারা। দুলুর বিরোধিতায় তারা সম্পূর্ণ একাট্টা।
বিএনপির গ্রুপিংয়ের রাজনীতি এতোটাই নোংরা যে, নজির আছে বিপক্ষের নেতার বাড়ির উঠোনে মানুষের বিষ্ঠা নিক্ষেপের ঘটনারও। এ ঘটনায় হয়েছে জিডিও।
এছাড়া বিপক্ষ গ্রুপের ক্যাডারদের ককটেলবাজির ভয়ে নিজের বাড়ির জানালার বাইরে শক্তিশালী লোহার জালি লাগিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বহিষ্কৃত নেতা শহিদুল ইসলাম বাচ্চু।
এছাড়া বিপক্ষ গ্রুপকে প্যাঁচে ফেলতে শহরের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে গোপন আঁতাতের বিষয়টিও অনেকটাই ‘ওপেন সিক্রেট’ নাটোর শহরে।
কানাইখালি মোড়ের চায়ের দোকানের ওই আড্ডায় অংশ নেওয়া শহরের এক আইনজীবী জানালেন, দুই দলের নেতারাই তাদের বিপক্ষ গ্রুপকে ঠেকাতে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিপক্ষ দলের নেতাদের সহায়তা করেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় স্থানীয় নির্বাচনগুলোতেও। নিজের অপছন্দের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে গোপনে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকে সহযোগিতা করার বিষয়টিও অনেকটা খোলামেলা।
‘শহরটা ছোট, কিন্তু পলিটিকস এখানে বড়’। মুচকি হেসে এ কথাই বললেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ওই নেতা।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৪ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৭
আরআই/এএসআর