ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভোটের-কথা

বিতর্কে এমপি নাজিম, ইকবাল-হিরণ দ্বন্দ্বে সুবিধায় নুরুল 

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৮
বিতর্কে এমপি নাজিম, ইকবাল-হিরণ দ্বন্দ্বে সুবিধায় নুরুল  .

ময়মনসিংহ: জীবনের শেষ বেলায় ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসন থেকে সংসদ সদস্য (এমপি) হয়েছেন নাজিম উদ্দিন আহমেদ। প্রায় ৫০ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার, পূর্ব পাকিস্তানের সময়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতিসহ নানা পদে দায়িত্ব পালন করেন। 

কারাবরণও করেছেন একাধিকবার। সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবুর রহমান ফকিরের মৃত্যুতে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে উপ-নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন।

 

তবে নিজের যুবলীগ নেতা ছেলে তানজির আহমেদ রাজিবের নানা কর্মকাণ্ডে এমপি বিতর্কিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন একই আসন থেকে দলটির মনোনয়ন প্রত্যাশী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ।  

আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে দলের দুঃসময়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, নাজিম উদ্দিন হচ্ছেন ‘পুতুল’। তার হয়ে সবকিছু করেন ছেলে রাজিব। এক সময় তাদের কিছুই ছিলো না। শুনছি এখন গাড়ি, জায়গা (জমি) ও বাসার অভাব নাই।  

এমপির ছেলে রাজিব ‘বিএনপি পুনর্বাসন কেন্দ্র’ খুলেছেন বলেও অভিযোগ প্রবীণ এই নেতার। তার ভাষ্যে-‘ছাত্রদল-যুবদলের অনেক নেতাকে দলে পদ দিয়েছে রাজিব। ’ 

আসনটির এমপির বিরুদ্ধে প্রায় একই রকম কথা বলেন গৌরীপুর পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম। রফিকুল গৌরীপুর সরকারি কলেজের জিএস, দুইবার করে পৌরসভার কাউন্সিলর ও মেয়র হয়েছেন।

আসন্ন সংসদ নির্বাচনে দলটির এই মনোনয়ন প্রত্যাশী বলেন, ছেলে রাজিবের কারণে অবশ্যই এমপি সাহেবের দুর্নাম হয়েছে। তাছাড়া তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মানুষকে ভুলে যান। এমপি দলে ঐক্য সৃষ্টি করার কোন উদ্যোগ নেননি, উল্টো নানা সমস্যার সৃষ্টি করেছেন।

দলটির এক নেতা বলেন, এমপির হয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে ছেলের ভূমিকায় স্থানীয় গৌরীপুরে এখন রব ওঠেছে ‘ঘরে-বাইরে ডাবল এমপি। ’ 

এই বিষয়টি সমর্থন করেন দলটির মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের দুই সাংগঠনিক সম্পাদক শরীফ হাসান অনু, ড. সামিউল আলম লিটন ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নাজনীন আলম।

বাংলানিউজকে তারাও বলেন, আমরাও শুনি গৌরীপুরে ডাবল এমপি, ট্রিপল এমপি। দলীয় সংসদ সদস্য হয়েও দলকে সুসংগঠিত করতে না পারায় একবাক্যে এমপির প্রতি নাখোশ।  

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে স্থানীয় এমপি নাজিম উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমার ছেলে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ‘আক্রোশের শিকার। আমি আবারো এমপি হয়ে মারা গেলে জনপ্রিয়তার কারণেই রাজিব এমপি হবে এমন আক্রোশ থেকেই তারা আমার ছেলেকে নিয়ে মনগড়া অভিযোগ তুলছেন।  

‘আমার ও আমার ছেলের বিরুদ্ধে কোনো অপবাদ নেই। আমার ছেলে টাকা পয়সা কামায়নি। ক্ষমতার অপব্যবহার করেনি। থানা বা চাকরির তদবির করে না। আমার মনোনয়নের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। ’

তবে বক্তব্য জানতে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সাড়া দেননি এমপির ছেলে রাজিব।  

দলটির বেশিরভাগ মনোনয়ন প্রত্যাশীই বিশ্বাস করেন, এবার নানা কারণেই আসনটিতে দলীয় মনোনয়ন পরিবর্তন করা হবে। প্রত্যেকেই নিজেদের মনোনয়নের বিষয়েও আশাবাদী।  

মনোনয়ন প্রসঙ্গে কৃষিবীদ ড.সামিউল আলম লিটন বলেন, আমাকে নৌকার মাঝি করা হলে বিপুলভোটে নির্বাচিত হয়ে আসনটি নেত্রীকে উপহার দেবো। আমি ২২ বছর ধরে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করছি। আমার মনোনয়নের জন্য গৌরীপুরের মানুষ জননেত্রী শেখ হাসিনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।  

১/১১ এর সরকারের সময়ে শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন উল্লেখ করে শরীফ হাসান অনু বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে এসপি কোহিনূরের রোষানলে পড়েছি। দীর্ঘদিন ধরে গৌরীপুরে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে মাঠে কাজ করছি।  

‘উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রায় ৪০ হাজারের মতো ভোট পেয়েও দলীয় বিরুদ্ধবাদীদের কারণে পরাজিত হয়েছি। আমি আশাবাদী মমতাময়ী নেত্রী আমাকে মূল্যায়ন করবেন। ’ 

মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বাবুল ওরফে ভিপি বাবুল বলেন, আমি ৩৫ বছর ধরে গৌরীপুরে রাজনীতি করি। শ্যামগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের ভিপি ছিলাম। ক’দিন আগে ৩০ হাজার কৃষককে নিয়ে কৃষক সমাবেশ করে আমি তাক লাগিয়ে দিয়েছি। আমি মনোনয়ন পেলে বিজয় সুনিশ্চিত।  

মনোনয়ন প্রত্যাশী নাজনীন আলম বলেন, জনপ্রিয়তা, কেন্দ্রীয় লবিইং, নারী কোঠা-সব সমীকরণেই আমি এগিয়ে রয়েছি। ২০১৪ সালে আমি বিপুল ভোট পেলেও আমি জয় বঞ্চিত হয়েছি। ২০১৬ সালের নির্বাচনে দলের নির্দেশে জেতা নির্বাচন ছেড়ে দিয়েছি। দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ আমার মনোনয়ন চান।  

এছাড়া আসনটিতে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলী আহাম্মদ খান পাঠান সেলভী, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোর্শেদুজ্জামান সেলিম, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল ডা. মতিউর রহমান, অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি মনোনয়ন প্রত্যাশী।  

এদিকে এই আসনটিতে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিতে চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই আসনে দলটিতে মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রকৌশলী এম ইকবাল হোসাইন ও উপজেলা চেয়ারম্যান আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণের মধ্যে সম্পর্ক সাপে-নেউলে।  

ইঞ্জিনিয়ার ইকবালের বিরুদ্ধে অভিযোগ, উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনি বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তার কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। মূলত দেশের বিতর্কিত এক শীর্ষ ব্যবসায়ীর বোনের স্বামী হিসেবে হুট করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পান।  

তিনি সব সময় ঢাকাতেই থাকেন। তার বাবা ফুলপুরে মুসলিম লীগের এমপি ছিলেন। সীমানা পুনর্বিন্যাসে তিনি গৌরীপুরের বাসিন্দা বনে যান।  

আর হিরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গায়ের জোরে রাজনীতি করতে চান। আওয়ামী লীগের সঙ্গে দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করেন। সিনিয়র নেতাদের লাঞ্ছিত ও হেনস্থা করেন।  

প্রয়াত উপজেলা বিএনপির সভাপতি মকবুল হোসেন বকুলের ওপর হামলা মামলায় এক নম্বর আসামি ছিলেন। দলের জন্য তিনি রীতিমতো এক ‘বিষফোঁড়া’।  

হিরণের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগকে সমর্থন করে স্থানীয় উত্তর জেলা যুবদলের সভাপতি শামসুল হক শামসু বাংলানিউজকে বলেন, ‘হিরণ আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চলেন। তাকে বলা হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’।  

অভিন্ন অভিযোগ উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর আনিছেরও।  

তবে এই দুই নেতার দ্বন্দ্বে আসনটিতে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল হক। মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত নেতা-কর্মীদের আইনী সেবার পাশাপাশি দেখভালের জন্য নুরুল হকের সুনাম রয়েছে।  

মনোনয়নে আশাবাদী অ্যাডভোকেট নুরুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি দলীয় কর্মকাণ্ডে সার্বক্ষণিক থাকি। ছাত্রদল, যুবদল করে এখন বিএনপির রাজনীতি করছি। দুইবার জেলা বারের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম।  

‘আর ইকবাল সাহেব কখনও ছাত্রদল যুবদল করেননি। তিনি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর কাছে ১ লাখ ৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। এবার প্রার্থিতা পরিবর্তন সময়ের দাবি। ’ 

অভিযোগের বিষয়ে প্রকৌশলী ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব না হলেও উপজেলা চেয়ারম্যান আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণ বলেন, আমার দ্বারা কোনো নেতা-কর্মী লাঞ্ছিত হয়নি।  

‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করলে ১৩ বার গ্রেফতার হতাম না। ৪৪ মাস ধরে সরকারি ভাতাও পাই না,’ দাবি করেন তিনি।  

বাংলাদেশ সময় ০৯৪৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৮ 
এমএএএম/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।