ঢাকা, শনিবার, ১ চৈত্র ১৪৩১, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১৪ রমজান ১৪৪৬

অন্যান্য

‘এমপি’ বাবুর মদদে বেপরোয়া লাক মিয়া

সুমন বর্মণ, আড়াইহাজার থেকে ফিরে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২১ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৫
‘এমপি’ বাবুর মদদে বেপরোয়া লাক মিয়া

ঢাকা: নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের ছোট বিনাইচর গ্রামের কৃষক লাল মিয়া দম্পতির দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে কুদরত আলী সরকারি চাকরিজীবী, আর ছোট ছেলে আবদুল মতিন শারীরিক প্রতিবন্ধী।

১৮ শতাংশ কৃষিজমিই ছিল তাঁদের একমাত্র সম্বল। সেই জমিতে চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন লাল মিয়া।

একসময় সেই জমিতে চোখ পড়ে ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান

গডফাদার লাক মিয়ার। জমি দখল করতে রাতের আঁধারে কৃষক লাল মিয়ার পরিবারের ওপর হামলা চালায় লাক মিয়ার সন্ত্রাসী বাহিনী। কুপিয়ে গুরুতর জখম করে শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুল মতিনকে। একমাত্র সম্বল কৃষিজমিটি হারানোর দুঃখ নিয়ে মারা গেছেন কৃষক লাল মিয়া।

তার মতো নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের হাজারো মানুষের স্বপ্ন তছনছ করে দিয়েছেন স্থানীয় সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত আওয়ামী গডফাদার চেয়ারম্যান লাক মিয়া। ক্ষমতার অপব্যবহার, নিরীহ মানুষের জমি দখল, নদী দখল করে শিল্প স্থাপন, মাদক কারবারসহ অসংখ্য অপকর্মে জড়িয়েছে তার নাম। লাক মিয়া একা নন, এমপি বাবুর প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তার পরিবারের সদস্যরাও। লাক মিয়ার ভাতিজা নাঈম হাসান সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া মেধাবী এক ছাত্রীকে অপহরণের পর ধর্ষণ করেন।

লাক মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের সীমাহীন অত্যাচার থেকে বাঁচতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন আড়াইহাজারের সাধারণ মানুষ।

আড়াইহাজার উপজেলার উজান গোবিন্দ গ্রামের দিনমজুর ছাবেদ আলীর ছেলে লাক মিয়া। ছয় ভাইয়ের সংসারে অভাব অনটনের মধ্যে বড় হন লাক মিয়া। বড় ভাইয়ের হাত ধরে তাঁতের ব্যবসা দিয়ে তার শুরু হলেও অভিযোগ রয়েছে, একচেটিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে আড়াইহাজারের তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করেছেন লাক মিয়া ও তার ভাইয়েরা। দাদন দিয়ে তারা তাঁতকল ভাড়া নিয়ে একসময় সেই কারখানা দখল করে নিতেন।

এভাবে তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পুঁজি হারিয়ে ব্যবসা ছেড়েছেন অনেক তাঁত ব্যবসায়ী।

২০০৮ সালে নজরুল ইসলাম বাবু আড়াইহাজারের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে লাক মিয়ার। আওয়ামী রাজনীতি না করেও হয়ে ওঠেন এমপি বাবুর ঘনিষ্ঠজন। ২০১৩ সালে এমপি নজরুল ইসলাম বাবুকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন লাক মিয়া। এমপি বাবুর প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে পুরো ইউনিয়নবাসীকে জিম্মি করে লাক মিয়া গড়ে তোলেন বিশাল ক্যাডার বাহিনী। এই বাহিনীর সহায়তায় তার স্পিনিং মিলের পরিধি বাড়াতে নিরীহ মানুষের বাড়িঘর, জমি দখল করে নেন। তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করার সাহস পাননি কেউ। কেউ প্রতিবাদ করলে ধরে এনে বিচারের নামে চালানো হতো নির্যাতন। মামলা দিয়ে করা হতো হয়রানি। গত ১৬ বছরে স্পিনিং মিলের বেশ কয়েকটি ইউনিট বাড়ান লাক মিয়া।

অবৈধ টাকার দাপটে টানা তিনবার ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ দুবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এমপির দাপট আর সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে প্রার্থী হতে সাহস পাননি।

আড়াইহাজার-ভুলতা আঞ্চলিক মহাসড়কের বিনাইচর গ্রামের দুই পাশ ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে চেয়ারম্যান লাক মিয়ার শিল্প-কারখানা ‘ভাই ভাই স্পিনিং মিলস লিমিটেড’। একে একে সড়কের দুই পাশে গড়ে তোলা হয়েছে ‘জামান স্পিনিং মিলস লিমিটেড’, ‘লতিফা স্পিনিং মিলস লিমিটেড’, ও ‘সাবেদ আলী স্পিনিং মিলস লিমিটেড’-এর ১০টি ইউনিট। কয়েক শ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় চার লাখ স্পেন্ডেল।

স্থানীয়রা জানায়, নিরীহ মানুষের জমি ও ব্রহ্মপুত্র নদ দখল করে গত দেড় দশকে গড়ে তোলা হয় এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান। আওয়ামী নেতা হওয়ায় সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসন ছিল অসহায়। লাক মিয়া বনে যান এই এলাকার অঘোষিত ভূপতি। তবে অভিযোগ আছে, এসব মিল-কারখানার বেশির ভাগ জমি দখল করেছেন তিনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও লাক মিয়ার ক্ষমতায় সামান্য আঁচড় লাগেনি। অভিযোগের পাহাড় জমলেও কেউ কথা বলার সাহস করছেন না।

২০০৪ সালের দিকে লাক মিয়া ও তার ভাই হক মিয়া বিনাইচরে কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেন। কারখানার অদূরে ব্রহ্মপুত্র নদের পারে ১৫ শতাংশ জমিতে ছিল কৃষক জুলহাস মিয়ার ফসলি জমি ও বাড়ি। ছয় সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ছিল তার বাস। সেই জমিতে নজর পড়ে লাক মিয়ার ভাই হক মিয়ার। জমি দিতে রাজি না হওয়ায় তার স্ত্রী ও মেয়েকে দেওয়া হয় ধর্ষণের হুমকি। ওই হুমকি উপেক্ষা করে কিছুদিন থাকতে পারলেও এক রাতে ২০ থেকে ৩০ জনের একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী তার বাড়িতে হামলা চালায়। হামলাকারীরা এক দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে আলটিমেটাম দেয় জুলহাস মিয়াকে। না হলে তার পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। শেষে বাধ্য হয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভিটেবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন কৃষক জুলহাস মিয়া। আদি পেশা ছেড়ে বর্তমানে কালীবাড়ি বাজারে পান-বিক্রি করে জীবন ধারণ করছেন তিনি। সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হলেও প্রাণভয়ে কথা বলেননি জুলহাস মিয়া।

লাক মিয়ার স্পিনিং মিলের পাশে উজান গোবিন্দী বাঁশতলা ঘাট। সেখানকার মোড়ে রাসেল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কথা হয় মালিক রাসেল ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, মিলের ভেতরে তাঁদের পৈতৃক ২০ বিঘা জমি রয়েছে। সেই জমি জোর করে দখল করে নিয়েছেন চেয়ারম্যান লাক মিয়া। এই জমি হারিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। লাক মিয়া মানুষের ওপর যে অত্যাচার করেছেন তা বর্ণনা করার ভাষা নেই রাসেলের।

তার পাশেই কথা হয় রতন ডেকোরেটরের মালিক রতন ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘লাক মিয়া আমাদের ২৫ শতাংশ জমি দখলের চেষ্টা করেছেন। আমি বাধা দেওয়ার পর এমপি বাবু আমাকে হুমকি দিয়েছেন। সরকারি জমিতে আমার একটু ঘর পড়েছিল, তা ভাঙিয়েছেন। অথচ লাক মিয়া একই সরকারি জমি দখল করে বাউন্ডারি দিয়েছেন। তাদের ক্ষেত্রে কোনো আইন নেই। যত আইন আমাদের জন্য। ’

লাক মিয়ার সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলায় আহত হওয়ার পর থেকে আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারেন না ছোট বিনাইচর গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুল মতিন। তিনি বলেন, ‘২০ শতাংশ জমিই ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র সম্বল। সেই জমিতে চাষবাস করে দুই ভাই এক বোনের সংসার চালিয়েছেন বাবা। কারখানা করতে সেই জমিতে নজর পড়ে চেয়ারম্যান লাক মিয়ার। জমি দখল করতে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালান। সবাইকে কুপিয়ে আহত করেন। মরে গেছি ভেবে আমাকে ফেলে যান। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরও আমি ভালো (সুস্থ) হতে পারিনি। এ কারণে বিয়েও করা হয়নি। ’

সুলতান সাদী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মনজুর মিয়া বলেন, ‘পশ্চিম সরাবদী গ্রামে আমাদের একটি বাড়ি ছিল। বালি ফেলে জোর করে সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে লাক মিয়ার লোকজন। আজও আমি সেই জমির টাকা পাইনি। ’

শুধু আড়াইহাজার নয়, পাশের রূপগঞ্জের সাধারণ মানুষও চেয়ারম্যান লাক মিয়ার ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি। উপজেলার মর্তুজাবাদ এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করেন লাক মিয়া। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল, ছাত্রলীগ, যুবলীগ দিনে বাড়িঘর ছাড়ার হুমকি দিত আর রাতে পরিবারের নারীদের ওপর চালাত অত্যাচার। শিউরে ওঠার মতো সেসব ঘটনা। জোর করে ঘরে বসাত মদের আসর। প্রতিবাদ করলে নেমে আসত নির্মম নির্যাতন।

এক রাতেই দখল করে নেওয়া হতো আশপাশের জমি। মানুষের জমির ছোট ছোট বাউন্ডারি গুঁড়িয়ে দিয়ে তৈরি করা হতো সীমানাপ্রাচীর। মাঝখানে টাঙানো হতো লাক মিয়ার ‘ভাই ভাই স্পিনিং মিলে’র সাইনবোর্ড।

একজন ভুক্তভোগী পারভিন আক্তার জানান, তার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল নিজের একটি বাড়ি হবে। আর সেই বাড়িতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকবেন। তাই দিন-রাত মশারি কারখানা ও মেস-বাড়িতে কাজ করে নিজের একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন। তবে এই বাড়িই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। লাক মিয়ার শকুনের নজর পড়ে ওই বাড়িতে। লাক মিয়ার সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারে শেষ পর্যন্ত ওই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন পারভিন আক্তার।

লাক মিয়ার মতো এমপি বাবুর প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তার পরিবারের সদস্যরাও। লাক মিয়ার ভাতিজা নাঈম হাসান সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া মেধাবী এক ছাত্রীকে ২০১২ সালের ৭ এপ্রিল স্কুলে যাওয়ার পথে অস্ত্রের মুখে রাস্তা থেকে অপহরণের পর ধর্ষণ করেন। ওই মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয় ধর্ষক নাঈম হাসানের। ওই মামলায় দীর্ঘদিন কারাভোগের পর গত বছর সেপ্টেম্বরে জামিনে মুক্ত হন নাঈম। কারাগার থেকে বেরিয়েই বর্তমানে এলাকায় তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে প্রতিদিন মোটরসাইকেলে শোডাউন দিচ্ছেন। এই সন্ত্রাসী বাহিনীর আতঙ্কে অনেক ছাত্রী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, চেয়ারম্যান লাক মিয়া আড়াইহাজার উপজেলায় মাদক কারবারের বিস্তার ঘটিয়েছেন। তার এই মাদক কারবার দেখভাল করেন সোহেল মেম্বার। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি। লাক মিয়ার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ছিলেন বড় ভাই জয়নাল আবেদীন। জায়গা দখল করতে গেলে এক নারী ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে জুতাপেটা করেন। ওই লজ্জায় হার্ট অ্যাটাক করে পরে মারা যান তিনি।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক মামলায় কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার করা হয় লাক মিয়াকে। তবে ২০২৩ সাল থেকে তিনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি। এই সাজা মাথায় নিয়ে থানা পুলিশের সামনে দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়াতেন লাক মিয়া। তার বিরুদ্ধে আড়াইহাজার, নরসিংদীর মাধবদী ও রাজধানীর ভাটারা থানায় হত্যা, অস্ত্র, চেক জালিয়াতিসহ অন্তত ৯টি মামলা রয়েছে। চেক জালিয়াতির মামলায় লাক মিয়া এক বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, ‘সাবেক এমপি বাবুর ক্যাশিয়ার ছিলেন চেয়ারম্যান লাক মিয়া। লাক মিয়া বিগত সময়ে এলাকায় যে অপকর্ম করেছেন এবং মানুষকে হয়রানি ও জুলুম করেছেন, এ বিষয়ে নির্যাতিতরা অভিযোগ করলে আমরা মামলা গ্রহণ করব। এ ছাড়া লাক মিয়ার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসছে সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই লাক মিয়া যাতে আইনের বাইরে যেতে না পারেন সে বিষয়ে পুলিশ কাজ করছে। ’

সৌজন্য: কালের কণ্ঠ

বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।