ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ ভাদ্র ১৪৩২, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

অন্যান্য

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ : গণতন্ত্রের অবিচল ভিত্তি

ব্রি. জেনারেল ড. এ কে এম শামছুল ইসলাম (অব.)। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:২২, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৫
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ : গণতন্ত্রের অবিচল ভিত্তি ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তি হচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদ কোনো সংকীর্ণ ভৌগোলিক ধারণা নয়; বরং তা মহান মুক্তিযুদ্ধে জনসাধারণের অভূতপূর্ব ঐক্যের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা এনে দেয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তখন থেকেই এক নতুন জাতিরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার সূচনা হয়।

জনগণের সেই আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধীনতা, স্বাধিকার এবং জাতীয় আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রকে স্তব্ধ করে বাকশাল প্রবর্তন করলে সেই আকাঙ্ক্ষার অকালমৃত্যু ঘটে। বাকশালের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিলুপ্ত হয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ হয়, আর জনগণ আবার একদলীয় স্বৈরশাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়, যা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রয়োজনীয়তাকে আরো তীব্র করে তোলে। এই প্রেক্ষাপটেই আবারও আবির্ভাব ঘটে মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের; যিনি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দর্শন উপহার দেন, যার নাম ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন যে স্বাধীনতা শুধু ভৌগোলিক নয়; বরং একটি জাতির আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার সম্মিলিত রূপ। মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে জাতীয় পরিচয়কে শুধু ভাষাভিত্তিক বা জাতিগত পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রবণতা বাংলাদেশকে সংকীর্ণতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, শহীদ জিয়া এই সংকীর্ণতার জাল ছিঁড়ে ঘোষণা করে—‘আমরা বাংলাদেশি’। যা প্রতিটি নাগরিককে একই পতাকার নিচে একত্র করে।

এই রাজনৈতিক দর্শনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি।

বিএনপি প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল—একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করা, যেখানে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য  থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি হবে জনগণের অংশগ্রহণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।

বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শের মূল ভিত্তি ছিল চারটি :

১. বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ—যেখানে নাগরিক পরিচয়, ভৌগোলিক ঐক্য এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তি। ২. গণতন্ত্র—যেখানে জনগণ হবে ক্ষমতার উৎস, নির্বাচন হবে সরকারের বৈধতার একমাত্র ভিত্তি। ৩. অর্থনৈতিক মুক্তি ও উন্নয়ন—যেখানে গ্রামোন্নয়ন, কৃষি বিপ্লব, স্বনির্ভরতা ও শিল্পায়ন হবে রাষ্ট্রের অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। ৪. আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও কূটনীতি—যেখানে বাংলাদেশ থাকবে নিরপেক্ষ, তবে সার্বভৌম ও মর্যাদাবান, কোনো শক্তির মুখাপেক্ষী হয়ে নয়।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে দরকার ছিল এমন এক নেতৃত্ব, যা জাতিকে বিভক্তির রাজনীতি থেকে মুক্ত করে একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয়ের অধীনে একত্র করবে। গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করবে। সেই প্রয়োজন পূরণের নিরিখেই বিএনপির জন্ম। কিন্তু ইতিহাসের পথ সব সময়ই বন্ধুর, কঠিন ও অনিশ্চিত। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শাহাদাত বরণ করেন। জাতি আবারও এক শূন্যতার মধ্যে পড়ে। কিন্তু এই শূন্যতায়ও জাতীয়তাবাদের মশাল নিভে যায়নি। সেটি শক্ত হাতে তুলে নেন তাঁর সহধর্মিণী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর অকুতোভয় নেতৃত্বের মাধ্যমেই সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশের আপামর জনসাধারণ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের সংগ্রামে তিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে দৃঢ়ভাবে উন্নীত করেন। তাঁর নেতৃত্বেই বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় এসে দেশের অর্থনীতি, অবকাঠামো, শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।

বেগম খালেদা জিয়া প্রমাণ করেছেন যে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ শুধু নিছক একটি দর্শন নয়, বরং সমগ্র দেশ ও  জাতির জন্য এটি এক প্রায়োগিক বাস্তবতা। তাঁর আপসহীন সংগ্রামের কারণে তিনি আজ গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের প্রবণতা এবং বিদেশি শক্তির প্রতি নির্ভরশীলতা আবারও দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে। বিদেশি শক্তির মদদপুষ্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে রাষ্ট্র পরিণত হয়েছিল একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায়, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়। বাকস্বাধীনতা দমন করা হয়। বিরোধী দলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সব পথকে রুদ্ধ করার জন্য মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয় গণতন্ত্রের  প্রতীক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে।

এই সময়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আরেক উত্তরাধিকারী হিসেবে এগিয়ে আসেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিদেশে অবস্থান করেও তিনি দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারেক রহমান দেশের জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যেমন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছিল, তেমনি আজও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান তারেক রহমানের নেতৃত্ব ও আহ্বানের ফলশ্রুতি, যা ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জাতির জাগরণের প্রতীক।

তারেক রহমান নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করছেন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হিসেবে তার অবস্থান দৃঢ় করছেন। তিনি বারবার ঘোষণা করেছেন-‘বাংলাদেশ কারো দান নয়, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল। ’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই তিনি প্রমাণ করেছেন যে জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আজও সমকালীন প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি আজও জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার প্রধান শক্তি। শহীদ জিয়া যে দর্শন দিয়ে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়া সেই দর্শনকে জীবিত রেখেছেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। আর ২৪-এর ফ্যাসিবাদবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান ও রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে তারেক রহমান সেই দর্শনকে নতুন প্রজন্মের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিছক ইতিহাস নয়, এটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। যত দিন বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে, তত দিন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকবে। আর এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করবে বিএনপি। কারণ এই দলটি গঠিত হয়েছে স্বাধীনতার মর্মকথা থেকে, আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম থেকে এবং গণমানুষের অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার থেকে। বিএনপি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভিত্তিকে শক্তিশালী করেছে এবং জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষাকে রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ দিয়েছে।

অতএব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আজ যেমন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত, তেমনি এর ভবিষ্যৎও একই দর্শনের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের জনগণ কখনোই সেই ইতিহাস ভুলবে না- বাকশালে নিমজ্জিত অন্ধকার দেশকে রক্ষা করেছে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আলোকবর্তিকা। জনগণ স্মরণ রাখবে, বেগম খালেদা জিয়ার আপসহীন সংগ্রাম আর তারেক রহমানের দৃঢ় নেতৃত্বই আগামী দিনের বাংলাদেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নেবে। সেই বিবেচনার নিরিখে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ শুধু রাজনৈতিক দর্শনমাত্র নয়; বরং এটি বাংলাদেশের অস্তিত্ব, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং গণমানুষের মুক্তির স্থায়ী নিশ্চয়তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এক রাজনৈতিক বাস্তবতার নাম।

লেখক : রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।