দেশের মৎস্য খাতে বিশাল সম্ভাবনা গভীর সমুদ্র। অথচ মৎস্য উৎপাদনে মাত্র সাত লাখ টন আসে সমুদ্র থেকে এ খাতের চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন র্যানকন গ্রুপের সি-ফিশিং ডিভিশনের সিইও তানভীর শাহরিয়ার রিমন
বাংলাদেশের সমুদ্রে ও গভীর সমুদ্রে মৎস্য খাতের সম্ভাবনা কেমন?
বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৪৫ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপন্ন হয়, যার মাত্র সাত লাখ টন আসে সমুদ্র থেকে।
এই খাতে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—এসব মাছ যদি কখনো হারিয়ে যায় বা আমাদের জলসীমায় যদি না আসে তাহলে আমাদের দেশের বাণিজ্যিক মিড ওয়াটার ট্রলারগুলো যথেষ্ট হুমকির মুখে পড়বে। এ জন্য সাগরের ইকো সিস্টেম ঠিক রাখতে সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করতে হবে আমাদের। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭১ সালে আমাদের সমুদ্রে ৪৭৫টি মাছের প্রজাতি ছিল, এখন তা নেমে এসেছে ৩৯৪টিতে। এর পেছনে আছে অপরিণত মাছ ধরা, অতিরিক্ত আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণ। এসব বিষয়েও সতর্ক হতে হবে।
গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার বাস্তব চিত্র কী?
আমাদের সমুদ্রসীমা ও ইইজেড (এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক অঞ্চল) যথেষ্ট বড়। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, ১০ মিটার গভীরতায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ, ১০ থেকে ৪০ মিটারে জেলেরা কাঠের নৌকা দিয়ে মাছ ধরেন, আর ৪০ মিটার থেকে তার অধিক এলাকায় শিল্পভিত্তিক ট্রলার চলে। বর্তমানে দেশে প্রায় ২০০টি শিল্প ট্রলার ও ৬৮ হাজার ছোট নৌকা আছে।
সমস্যা হলো, অনেক জেলে অনুমোদিত সীমা অতিক্রম করে শিল্প ট্রলারের এলাকায় চলে আসেন এবং অবৈধ জাল ব্যবহার করেন, যা ইকোসিস্টেমের জন্য হুমকি। এটি রোধে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ দরকার। আমাদের সমুদ্র এলাকার মোট পরিমাণ ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার, যার প্রায় চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় আমাদের দেশের জাহাজগুলো মৎস্য আহরণ করে থাকে, তা ছাড়া আমাদের সামুদ্রিক জলসীমায় প্রায় আশির দশকের দিকে দেশি এবং বিদেশি ব্যবস্থাপনায় সার্ভে করে কয়েকটি ফিশিং গ্রাউন্ড সৃষ্টি করা হয়, আশির দশকের পর আর কোনো নতুন ফিশিং গ্রাউন্ড তৈরি হয়নি। তাই সময় এসেছে আবার সার্ভে করে নতুন নতুন ফিশিং গ্রাউন্ড তৈরি করার, অন্যথায় ভবিষ্যতে আমাদের সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
নীতিগত ও প্রশাসনিক বাধাগুলো কী কী?
জাহাজ প্রতিস্থাপন ও মালিকানা পরিবর্তন সহজীকরণ প্রয়োজন, আইইউইউ ফিশিং মনিটরিং আরো জোরদার করা প্রয়োজন, চড়া ব্যাংক সুদের হার এই খাতের জন্য অযৌক্তিক।
ব্যাংক ভর্তুকি ও নীতিগত সহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন। তা ছাড়া নতুন মৎস্য নীতিমালা অনুযায়ী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে বটম ট্রলিং জাহাজগুলোকে প্রতিস্থাপন করে মিডওয়াটর ট্রলারে রূপান্তর করতে হবে। তাই প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া আরো সহজীকরণ করতে হবে। তা ছাড়া, লাইসেন্স বা মালিকানা পরিবর্তন প্রক্রিয়াও আরো সহজীকরণ করা প্রয়োজন।
সরবরাহব্যবস্থায় প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?
বেশির ভাগ ট্রলার পুরনো, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব। দুই বছরে ডিজেলের দাম ৩২ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু মাছের দাম তেমন বাড়েনি। ভালো কোল্ড স্টোরেজের অভাব রয়েছে। নতুন মাছের প্রজাতি, মাছ ধরার এলাকা বা প্রযুক্তি—এই তিনটি বিষয়ে সরকারি উদ্যোগে গবেষণা অত্যন্ত প্রয়োজন।
সম্প্রতি মৎস্য মন্ত্রণালয় ফিশিং ব্যান ৬৫ দিনের পরিবর্তে ৫৮ দিন করেছে। এতে ইতিবাচক কোনো দৃষ্টান্ত আছে?
অবশ্যই, আমরা মনে করি এটা ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে। কৌশলগত এই সিদ্ধান্তে আমাদের মৎস্য খাত উপকৃত হবে। ফিশিং ব্যান প্রিওডে আর্টিসান বা বোটের নাবিকদের সরকার নানা রকম আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের বাণিজ্যিক ট্রলারের নাবিকদের ওই সময় তাঁদের বেতন, বোনাস, খাদ্য ভাতা ইত্যাদি দিতে চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়। তাই বাণিজ্যিক ট্রলারগুলোর নাবিকদেরও সরকারি উদ্যোগে প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া আমি মনে করি আমাদের ফিশিং ব্যানের সময়কালে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধে ফ্লেক্সিবিলিটি থাকা প্রয়োজন। কারণ তখন আমাদের মৎস্য ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ থাকে।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক জাহাজ সরাসরি ইউরোপে মাছ রপ্তানির অনুমতি পেয়েছে বলে আমরা জেনেছি, আপনাদের কোনো জাহাজ কি এই মানদণ্ডে পৌঁছতে পেরেছে?
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে সরাসরি জাহাজ থেকে ব্লক ফ্রোজেন মাছ রপ্তানির অনুমতি মিলেছে। সরাসরি জাহাজ থেকে ব্লক ফ্রোজেন মাছ এবং চিংড়ি ইউরোপের বাজারে রপ্তানির সুযোগ এই প্রথম এলো। মাত্র পাঁচটি জাহাজ এই অনুমতি পেয়েছে, যার মধ্যে আমাদের রয়েছে দুটি জাহাজ। আমাদের আরেকটি জাহাজ অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এখানে সরকারের সংস্থাগুলোর ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। এতে আমাদের রপ্তানি বাজার বড় হবে। আন্তর্জাতিকমানে রপ্তানি সম্ভব হবে এবং বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হবেন।
বিনিয়োগ আকর্ষণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
বিনিয়োগ আকর্ষণে লাইসেন্স প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে হবে। আধুনিক বন্দর, কোল্ড চেইন ও লজিস্টিক হাব গড়ে তুলতে হবে। মাছের উৎস থেকে রপ্তানি পর্যন্ত ট্রেসেবিলিটি নিশ্চিত করতে হবে। পিপিপি মডেলে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি ও দক্ষতা আমদানি করতে হবে। সরকারের উচিত পুঁজি ঝুঁকির কিছু অংশ ভাগ করে নেওয়া, এটা রপ্তানিতে সাবসিডি বাড়ানোর মাধ্যমে করা যায়। কিন্তু উল্টো এখন সাবসিডি কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এবং চিংড়ি রপ্তানিতে সাবসিডি কমেছেও। এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। কারণ বৈশ্বিক চিংড়ির বাজারে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। চাষকৃত ভেনামি চিংড়ি রপ্তানিতে ভারত, ভিয়েতনাম, ইকুয়েডর অনেক এগিয়েছে। ভেনামির চাহিদাও বেড়েছে অনেক। ফলে আমাদের সাগর থেকে আহরণকৃত অর্গানিক চিংড়ির দাম বিশ্ববাজারে পড়ে গেছে। বলতে পারেন অর্ধেক হয়ে গেছে। এই অবস্থায় সামুদ্রিক চিংড়ি খাত বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। তাই প্রণোদনা না কমিয়ে বিনিয়োগকারীদের পাশে থাকা উচিত। ওয়ান-স্টপ সার্ভিস, কর ছাড় ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদান দরকার। এ ছাড়া আমি মনে করি, সাগরে মৎস্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় ফিশিং গ্রাউন্ড থেকে নানা রকম ক্ষতিকারক বর্জগুলো তুলে আনা প্রয়োজন।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ